পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে জীবজগতে এক বড় পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এই বিপর্যয়ের হাওয়া লেগেছে সুপেয় পানিতেও! আশঙ্কাজনক হারে সুপেয় পানির স্তর দিনের পর দিন নিচে নেমে যাচ্ছে! শুধু বাংলাদেশ নয় এই সংকট তৈরি হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী। কয়েক বছর আগেও অঞ্চলভেদে ১২-১৫ ফুট গভীরে গেলে সুপেয় পানির সন্ধান মিলত; কিন্তু এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে। পানির স্তর পেতে পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ গভীরে পৌঁছাতে হয় এখন। কাজেই সহজেই অনুমেয়, পরিস্থিতি কোনদিকে অগ্রসর হচ্ছে!
পৃথিবীতে সুপেয় পানির পরিমাণ অসীম নয়, এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পৃথিবীতে যতটুকু পানি সঞ্চিত আছে তার ৯৭ শতাংশ লবণাক্ত পানি আর বাকি ৩ শতাংশ সুপেয় পানি। এই ৩ শতাংশ পানি শুধু ভূগর্ভস্থ নয়। এই ৩ শতাংশ পানি পৃথিবীতে বিভিন্নরূপে সঞ্চিত আছে। ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ বরফরূপে, ৩০ দশমিক ১ শতাংশ ভূগর্ভস্থে, ০ দশমিক ৩ ভূউপরস্হ মিঠা পানি! পর্যবেক্ষণ বলছে, এই ভূউপরস্হ মিঠা পানির মোট পরিমাণের ৮৭ শতাংশ রয়েছে বৈকাল হ্রদে, ১১ শতাংশ রয়েছে বিভিন্ন জলাভূমিতে এবং ২ শতাংশ রয়েছে নদী, খালবিল ও পুকুরে! পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তুলনায় এই পানি খুবই কম। এই সীমিত পানির ভাণ্ডার শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। এখনই ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন বন্ধ না হলে পৃথিবী এক কঠিন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং ভূগর্ভস্থ পানি কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেটা নিয়েও চলছে বিস্তর গবেষণা। গবেষকরা মতামত দিচ্ছেন, ভূগর্ভস্থ পানি কম উত্তোলন করে ভূউপরি ভাগে যে পানি রয়েছে সেটা রিসাইকেল করে ব্যবহার করতে হবে। এতে করে আগামীতে খুব একটা পানি সংকটে পড়তে হবে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘পৃথিবীতে পানির সংকট কখনো তৈরি হবে না, কারণ আমরা যে পানি ব্যবহার করি, সেটা নষ্ট হলেও দিনশেষে মাটিতেই ফিরে যায়। বিভিন্ন লেয়ারে রিসাইকেল হতে হতে সেটা ভূগর্ভে জমা হয় এবং প্রয়োজন হলেই মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে।’
সুপেয় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ ইতিমধ্যে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সবুজ বনায়ন ধ্বংস, খরা, শিল্পকারখানার ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ, অধিক নগরায়ণ এবং অপরিকল্পিতভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদি। এই সংকট থেকে জীব ও পরিবেশ রক্ষা করতে সবুজায়ন পৃথিবীর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের কথা চিন্তা করলেও দেখা যায়, গত পনেরো বছরে কেমন বৃষ্টিপাত হতো এবং দেশটি মোট ভূমির কত শতাংশ বনভূমি ছিল আর এখন কত! এখন বৃষ্টিপাত অনেক কমে গেছে। এমনকি বর্ষাকালেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি নেই। বর্ষার সময় সব নদনদী পানিতে থইথই করার কথা অথচ নদীগুলোর চেহারা দেখলে মনে হয় এ-কোন বেহাল দশা!
গবেষকদের মতে, সবচেয়ে বেশি পানি মজুত আছে কানাডাতে এবং সবচেয়ে কম কুয়েত! অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কুয়েত শক্তিশালী হওয়ায় ডিস্যালাইনেশন প্রক্রিয়ায় সমুদ্রের পানিকে পানের উপযোগী হিসেবে ব্যবহার করছে। সবাই এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাচ্ছে এবং এটাই করা উচিত; কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করা অনেক ব্যয়বহুল।
২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে আরো ২০০ কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে; কিন্তু সুপেয় পানির উৎস বৃদ্ধি পাবে না। এরমধ্যে হয়তো কিছু জনসংখ্যা মারাও যাবে কিন্তু উদ্ধৃত যে জনসংখ্যা থেকে যাবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পানি কোথা থেকে আসবে? আর আসলেও সেটা আরো কত বছর পাওয়া যাবে? এই একটা শঙ্কা অবশ্য থেকেই যায়। এজন্য পৃথিবীতে জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গেলে সুপেয় পানির কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার বন্ধ করা এবং পানি দূষণের মাত্রা কমিয়ে একদম শূন্যের কোঠায় আনা এখন সময়ের দাবি। এই বিশাল জীবজগতকে টিকিয়ে রাখতে এখন থেকেই সবাইকে সচেতন হতে হবে; তা না হলে ভবিষ্যতে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
লেখক :শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়