আমি দীর্ঘদিন ধরে পানি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি। দীর্ঘদিনের অর্জিত ও লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে সম্প্রতি বাংলাদেশের নদী ও অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছি। আমি লক্ষ করি, ২০১০ সালের পর আমাদের দেশের অনেক মানুষই নদী নিয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ নদী নিয়ে বিভিন্ন রকম কাজও করছেন। নদীর প্রতি এই ভালোবাসা আমাকে আশান্বিত করেছে। যারা ইদানীং নদী নিয়ে কাজ করছেন, তাদের বয়সও খুব একটা বেশি নয়। ফলে আমাদের আশাবাদী হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। উল্লেখ্য, আমাদের জাতীয় জীবনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এমন এক সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা ও পরিবহনব্যবস্থা ছিল কার্যত নদীনির্ভর। নদী আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রাখত। এখন দেশের অধিকাংশ নদনদী শুকিয়ে গেছে। পানিস্বল্পতার কারণে অনেক নদীই এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। অনেক নদী বর্ষার পর শুকিয়ে যায় অথবা নৌ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বর্তমানে আমাদের পণ্য ও যাত্রী চলাচলের প্রধান বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু নৌপথে পণ্য পরিবহন এবং যাত্রী চলাচল তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। নদীগুলোর অবস্থা হয়তো আগের মতো ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, বিশেষ করে নদী খনন ও নদীকে সচল রাখার ব্যবস্থা করা গেলে এখনো নৌপথ আমাদের দেশের অর্থনীতিতে তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
নদনদী আমাদের দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও নদনদী সম্পর্কে তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা সমস্যা আছে। কারণ নদনদী নিয়ে প্রামাণিক গ্রন্থের অভাব রয়েছে। পেশাগত কারণে আমি যেহেতু দীর্ঘদিন নদনদী নিয়ে কাজ করেছি, তাই আমি ভাবলাম দেশের নদনদী নিয়ে একটি তথ্যভিত্তিক প্রামাণিক গ্রন্থ থাকলে ভালো হয়। এই উপলব্ধি থেকে আমি নদীবিষয়ক একটি প্রামাণিক গ্রন্থ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি।
ব্রিটিশ আমলে বিভিন্ন জেলার ইতিহাস লেখা হয়েছে। সেই জেলার ইতিহাস বইয়ে একপর্যায়ে জেলার নদীগুলোর নাম ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। আমি যে বইটি লিখেছি তাতে নদীর নাম, নদীটি কোন উপজেলায় অবস্থিত, এখন তার অবস্থা কেমন, নদীর দৈর্ঘ্য কতটুকু এবং কোথা থেকে শুরু হয়েছে—এসব মৌলিক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। এমনকি নদীর মানচিত্র দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, নদীটির বাস্তব অবস্থা কেমন ছিল। আমি যেহেতু পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছি, তাই আমার এ সংক্রান্ত বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই আমি বইটি লিখেছি। আশা করছি, যারা ভবিষ্যতে নদী নিয়ে গবেষণা করবেন, তাদের জন্য আমার বইটি রেফারেন্স বই হিসেবে কাজ করবে। নদী নিয়ে কেউ যদি সরেজমিনে কাজ করতে চান, তাহলে তার দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে, প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলতে হয়, যিনি নদী নিয়ে গবেষণা করবেন, তিনি যদি এই ব্যাকগ্রাউন্ডের না হন, তাহলে ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে।
একসময় নদী গবেষণা ইনস্টিটিউশনের মহাপরিচালক ছিলাম। ২০০২ সালে আমি রিভার মরফোলজি অ্যান্ড রিসার্চ সার্কেলের পরিচালক ছিলাম। সেই সময় আমার কাজ ছিল সারা দেশের নদীগুলোর হাল-অবস্থা জরিপ করা। ফলে আমি নদী সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাই। নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে জরিপ করার সময় আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, আমাদের নদনদী সম্পর্কে যে তথ্য আছে, তাতে নানা ধরনের অসংগতি ও বিভ্রান্তি রয়েছে। বইয়ে নদনদী নিয়ে যে বিভ্রান্তি রয়েছে, তা উল্লেখ করি।
আমার ধারণামতে, বাংলাদেশে অন্তত ৩ হাজার নদনদী আছে। অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। বাস্তবে নদী আছে কি নেই, সেটা বড় কথা নয়, বরং কথা হচ্ছে সিএস ম্যাপে নদী হিসেবে দেখানো হয়েছে কি না। নদী শুধু মানুষের জীবনধারণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, তা নয়। সংশ্লিষ্ট এলাকার পশু-পাখি, জীবনযাত্রা সবকিছুই নদীর ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির স্বাভাবিকতার জন্যও নদীর প্রয়োজন রয়েছে। আগে বাংলাদেশের অধিকাংশ শহর ও বাজার নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল; কারণ আগেকার দিনে নৌকাই ছিল সবচেয়ে সহজ পরিবহনব্যবস্থা। এক কথায় বলা যায়, নদীই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ। অনেক নদনদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমন অনেক নদী আছে, যেগুলোকে হাজার চেষ্টা করলেও আর চালু করা যাবে না। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে বা ভরাট হয়ে যাচ্ছে, এটা যত না সমস্যা, তার চেয়ে বেশি সমস্যা সৃষ্টি করেছে নদীদূষণ। নদীদূষণ বন্ধ করা না গেলে, ভবিষ্যতে অধিকাংশ নদীর পানি ব্যবহারযোগ্যতা হারাবে। আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল নদীকেন্দ্রিক, আর এখন চিত্রটা ভিন্ন।
প্রশ্ন হলো, দেশের জলপথ রক্ষা কীভাবে করা যায়? এর আগে আমাদের বুঝতে হবে, নদী বা জলপথ রক্ষা করার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কে? জলপথ রক্ষা করার জন্য উপযুুক্ত কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিওটিএ)। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ হলো নদীর পাড় রক্ষা করা। নদীতে ভাঙন দেখা দিলে পাড়ের জনগণকে রক্ষা করা। আর নদীপথকে রক্ষা করার দায়িত্ব হচ্ছে বিআইডব্লিউটিএর। কিন্তু এখানে সমন্ব্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। একজনের কাজ অন্যজনকে দিয়ে করানো হয়। ফলে সমস্যা দেখা দেয়। নদীসংশ্লিষ্ট কাজে যেসব প্রতিষ্ঠান যুক্ত আছে, তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলদা আইন আছে। কাজেই নদী সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তার পরও সমস্যা হচ্ছে। সারা বছর আমদের দেশে যে বৃষ্টিপাত হয়, তার খুব একটা তারতম্য হয়নি। বৃষ্টি আগে যে পরিমাণে হতো, এখনো প্রায় একই পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি বা উজান থেকে আসা পানিকে যে কোনো মূল্যেই হোক, সাগরে যেতেই হবে। কোনো নদী যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে অন্য কোনো নদী চালু হয়ে গেছে; এটা প্রাকৃতিকভাবেই হয়। কাজেই নদী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, তা নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমাকে অস্থির হতে হবে এটা ভেবে যে, এই নদীর তীরে একটি বন্দর ছিল, সেটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নদী বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এটা বড় উদ্বেগের বিষয় নয়, উদ্বেগের বিষয়, নদীর তীরে থাকা বন্দর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নদী বন্ধ হয়ে যাবার ফলে যে বন্দরটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেটা চালু রাখার প্রয়োজন আছে কি না। আমি হয়তো কয়েক শত কোটি টাকা ব্যয় করে নদীবন্দরটি চালু করলাম, কিন্তু দেখা গেল, সেখানে কোনো কার্গো আসতে পারছে না। এই অবস্থায় ভাবতে হবে, অন্য একটি স্থানে বন্দর নির্মাণ করলে তা অর্থনৈতিকভাবে ভায়াবল হবে কি না। যদি ভায়াবল হয়, তাহলে অন্যত্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কোনোভাবেই আটকানো যাবে না। আমরা প্রয়োজনে নদী থেকে পানি তুলতে পারি কিন্তু কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করে নদীর পানির স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করা যাবে না। নদীর একটি ন্যূনতম প্রবাহ আছে, সেই প্রবাহ প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে চলতে দিতে হবে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ যদি বন্ধ করা হয়, তাহলে নদী মরে যেতে পারে। মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বাঁচতে পারবে না।
তৃতীয়ত, আমাদের দেশে যেসব জলাশয় ছিল, যেমন—বিল, বাঁওড় ইত্যাদি রক্ষা করতে হবে। প্রত্যেক বিলের একটি খাল আছে। যখন সিএস ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে, তাতে প্রত্যেক বিলের মাঝখানে কিছু খাসজমি রাখা হয়েছে। এই খাসজমিটি কোনো মানুষের নয়। এটা কোনোভাবেই হস্তান্তরযোগ্য নয়। এই খাসজমিটি হচ্ছে, শীতকালে আমাদের দেশে আসা পরিযায়ী পাখি ও মা-মাছের আশ্রয়স্থল। এই খাসজমিকে মা-মাছের স্টক বলা যেতে পারে; অর্থাত্ বিলের পানি যখন কমে যাবে, তখন মা-মাছ এখানে আশ্রয় গ্রহণ করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, বিলের পানি বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মা-মাছের আশ্রয়স্থলকে লিজ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লিজ-গ্রহীতারা এখন থেকে মা-মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে ব্রিডিং স্টক। কিন্তু ব্রিডিং স্টকগুলোকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে; ফলে মা-মাছ ডিম দিতে পারছে না। প্রাকৃতিক মাছের উত্পাদন দিনদিন কমে যাচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে এসব ব্রিডিং স্টক রক্ষা করতে হবে। মাছের ব্রিডিং স্টক প্রয়োজনে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
লেখক: বিশিষ্ট পানিবিজ্ঞানী ও নদী গবেষণা ইনস্টিটিউশনের সাবেক মহাপরিচালক
অনুলিখন—এম এ খালেক