শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জীবনের অনুষঙ্গ পৃথিবীর পানিসম্ভার 

আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২২, ০৬:৫০

এই পৃথিবীতে জীবনের মূল উৎস পানি। জীবদেহের জৈবিক কার্যাদি পানির মাধ্যমেই সম্ভব হয়। খাদ্যের অভাবে মানুষ বেশ কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু পানির অভাবে মানুষ মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যায়। এক কথায়, পৃথিবীতে পানির অনুপস্থিতি মানে জীবনের অবলুপ্তি।

কঠিন, তরল ও বায়বীয়—এই তিন অবস্থায় পানির অসাধারণ বিচরণের কারণেই জগতে এক বিস্ময়কর পানিচক্র গঠিত হয়েছে, যা আমাদের পৃথিবীকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। ভূপৃষ্ঠের তরল পানি সূর্যের তাপে জলীয়বাষ্পে পরিণত হয়ে আকাশে উঠে যায়, এটিই আবার বৃষ্টির আকারে জমিনে ঝরে পড়ে পৃথিবীতে শস্য, ফল, ফুল, তরুলতা ও বনরাজির এবং বৈচিত্র্যময় প্রাণীকুলের সমাহার ঘটিয়ে চলেছে। পানির কারণেই পৃথিবীর উষ্ণতার তারতম্যক্রম (Range of difference) ভারসাম্যময় ও জীবনধারণের উপযোগী রয়েছে। দিনের বেলায় সূর্যের প্রচণ্ড তাপ শোষণ করে পানি পৃথিবীকে শীতল রাখে এবং রাতের বেলায় তাপ বিকিরণ করে পৃথিবীকে উষ্ণ রাখে। 

তাছাড়া, বায়ুমণ্ডলের উষ্ণ পরিবেষ্টনীতে জলীয়বাষ্প গরম সুতি পশম কাপড়ের স্তরের মতো তাপ অপরিবাহী মাধ্যম হিসেবে অবস্থান করে বলেই বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাশূন্যের প্রচণ্ড ঠান্ডা পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারে না। যদি ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে আয়তনে বৃদ্ধি পাওয়ার গুণটি পানির না থাকত, তবে পৃথিবী বহু আগেই হীমশীতল হয়ে যেত। অন্য পদার্থের মতো বরফ আয়তনে বৃদ্ধি না পেয়ে কমে গেলে তা পানিতে না ভেসে ডুবে যেত। এতে সাগর, নদী, হ্রদ বা জলাশয়ের নিচ থেকে বরফ হওয়া শুরু হতো, সব প্রাণী মারা যেত এবং প্রচণ্ড ঠান্ডার প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের সব জলীয়বাষ্প বরফে পরিণত হতো। এভাবে বায়ুতে কোনো জলীয়বাষ্পই অবশিষ্ট থাকত না। জলীয়বাষ্প না থাকলে বৃষ্টি হতো না এবং বৃষ্টি না হলে পৃথিবীতে প্রাণের পরিস্ফুটনও হতো না। তাছাড়া উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের অন্যতম উপাদানও পানি। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমেই সব জীব ও উদ্ভিদজগতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খাদ্যের ও বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের জোগান হয়।

আমাদের পৃথিবীতে পানি কোনো না কোনো আকারে সর্বত্র বিরাজমান। এমনকি মানবশরীরের শতকরা ৭১ ভাগই পানি। পৃথিবীর মোট পানির শতকরা ৯৫ ভাগ সাগর-মহাসাগরে, ১ দশমিক ৭ ভাগ ভূ-অভ্যন্তরে, ১ দশমিক ৭ ভাগ উঁচু পর্বত, এন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে বরফ আকারে, সামান্য অংশ নদনদী ও জলাশয়ে এবং শূন্য দশমিক ০০১ ভাগ জলীয়বাষ্প আকারে রয়েছে। সাগর-মহাসাগরের লবণাক্ত পানি সুপেয় নয়। পৃথিবীর মোট পানিসম্ভারের কমবেশি মাত্র ৩ শতাংশ পানি সুপেয়, যার দুই-তৃতীয়াংশই পৃথিবীর মেরু, তুন্দ্রা বা পর্বতশৃঙ্গে বরফাকারে আবদ্ধ রয়েছে। ভূ-উপরিভাগ থেকে লক্ষকোটি বছর ধরে শোষিত ভূ-অভ্যন্তরে একুইপার আকারে মজুতকৃত পানি এবং আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির পানিই আমাদের ব্যবহার্য পানির প্রত্যক্ষ উৎস। বিশ্বের পানীয়জলের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ, কলকারখানা ও শিল্প পরিচালনা চাহিদার ৪০ শতাংশ এবং কৃষি চাহিদার ২০ শতাংশ পানির জোগান হয় ভূগর্ভস্থ পানি দ্বারা (ইউনেসকো, ২০০৩)। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট কৃষিজমির ৭০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানির সাহায্যেই চাষাবাদ হচ্ছে (কোরাইশি এ এস ও অন্যান্য)। কিন্তু ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানিতে আর্সেনিক নামক এক বিষাক্ত রাসায়নিকের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় ঐ পানি খাওয়ার ফলে ইতিমধ্যে মানুষের মধ্যে বিষক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

বিগত ৫০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশ্বের পাগলপ্রায় জাতিগুলো কৃষি ও শিল্পপণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে বিশ্বের পানিসম্পদের অত্যধিক ব্যবহার ও বনজসম্পদসহ প্রকৃতি সংহারে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এতে লক্ষকোটি বছর যাবত বিশ্বকে ভারসাম্যপূর্ণ করে রাখা জটিল ইকোসিস্টেম ও পানিচক্র (এতে ক্ষুদ্র অণুজীব থেকে শুরু করে বৃহদাকার তিমি মাছ/বিটপি পর্যন্ত প্রতিটি প্রাণী, উদ্ভিদ বা অজৈব উপাদানের জানা-অজানা গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও ভূমিকা রয়েছে) মানুষের কয়েক বছরের ব্যাপক অপাঘাতে এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে। পৃথিবীর ৭০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপন্ন হয় যে সাগর-মহাসাগরে, তা-ও আজ মানুষের অবিমৃশ্যকারিতার শিকার। সাগরে তেল উত্তোলন ও তেল ট্যাংকার চলাচল ইত্যাদি কারণে পানিতে ব্যাপক তেল নিঃসারণ এবং প্লাস্টিক, ময়লা ও বর্জ্যদূষণে সাগরে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ও অক্সিজেন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের ঘাটতি পৃথিবীতে জীবননাশের কারণ হতে পারে।

পৃথিবীর ১ দশমিক ১ বিলিয়ন লোকের কাছে সুপেয় পানি সুলভ নয় এবং ৪ বিলিয়ন লোক বছরে কমপক্ষে এক মাস পানিস্বল্পতায় ভোগে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের দিকে প্রায় ৫ বিলিয়ন লোক চরম পানিসংকটের শিকার হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যসহ অতিরিক্ত কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী কৃষিসেচের পানির অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। পানিসংকট জাতিরাষ্ট্রগুলোর ভূরাজনৈতিক সম্পর্ককে পরস্পরবিরোধী অবস্থানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা বিশ্বশান্িতর জন্য হুমকির সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের আন্তর্জাতিক নদনদীগুলোর পানির হিস্যা নিয়ে দেশে দেশে বিবাদ এখন চরমে। উজানের অনেক দেশই সব আন্তর্জাতিক নির্দেশনা ও রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের মতো করে নদীতে বাঁধ দিয়ে পানির পুরো বা বৃহদাংশ নিজেরা ব্যবহার করছে। এতে বাংলাদেশের মতো ভাটিতে অবস্থিত দেশগুলোতে পানির চরম অভাব দেখা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নেপালের হিমালয় পর্বতমালা ও চীনের তিব্বত থেকে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রসহ বেশ কয়েকটি নদনদী উৎপন্ন হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। 

ইতিমধ্যে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা গঙ্গার পানি বাংলাদেশকে না দিয়ে তাদের দেশে কৃষিকাজে ব্যবহার করছে, যদিও বহু দিনের দরকষাকষির পর গঙ্গার পানির একটি হিস্যা ভারত বাংলাদেশকে দিয়েছে, যা বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য। ১৯৭৫ সালে ভারত বাংলাদেশের উজানে তিস্তা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করায় বাংলাদেশ তিস্তার পানিপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিস্তার পানি নিয়ে এখনো দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়নি। এদিকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর মিলনস্থল বরাক নদের উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করছে। আবার শোনা যাচ্ছে, ভারতের বরাক ও ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে চীন বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে। সিন্ধু, নীল নদ, টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস, দানিউব, মেকং ইত্যাদি নদনদীর পানি নিয়েও সংশিষ্ট দেশগুলোতেও চরম মতবিরোধ বিরাজ করছে। ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে এসব আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান প্রয়োজন, অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। ‘ইউরোপিয়ান কমিশন জয়েন্ট রিসার্চ সেন্টার’ তো ভবিষ্যদ্বাণীই করেছে যে আগামী শতকের ৭০-৯০ শতাংশ যুদ্ধের কারণ হবে দেশে দেশে পানির বিরোধ নিয়েই ।

বাংলাদেশে বারংবার সাইক্লোনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের ফলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা ঘটছে। তবে এর চেয়েও বেশি বিপজ্জনক হলো বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর ভূভাগে বিগত তিন-চার দশক জুড়ে চিংড়ি চাষের জন্য ক্রমবর্ধমানহারে সাগরের লবণাক্ত পানি ব্যবহারের এক অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। এতে দেশের অভ্যন্তরে মৃত্তিকার উপরিস্থরে ও মৃত্তিকার গভীরে আশঙ্কাজনক হারে লোনাপানির বিস্তৃতি ঘটছে। ক্রমবর্ধমান হারে লোনাপানির বিস্তৃতির জন্য কৃষি উপযোগী মৃত্তিকা চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষসহ সব প্রাণী ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য পানি এক অপরিহার্য ও মহাগুরুত্বপূর্ণ অমূল্য সম্পদ। পানি জীবন প্রদায়ী অক্সিজেন উৎপাদনের অন্যতম মাধ্যম। জীবন উপযোগী বিশ্বপরিবেশ বজায় রেখে এই সম্পদ কাজে লাগানোর জন্য বিশ্ববাসীকে সচেতন হতে হবে এবং এজন্য পানির অপচয়, মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং পানিদূষণ রোধে সুপরিকল্পিতভাবে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় পর্যায়ে আইনকানুন প্রণয়ন ও কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিটি দেশেরই উচিত জীবন রক্ষাকারী এই সম্পদের যেন অপব্যবহার, অপচয়, পরিবেশদূষণ বা অন্য কোনো অবিবেচক কর্মকাণ্ড দ্বারা এই সম্পদ ব্যবহারের অনুপযোগী করা না হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, পানি বিশ্ব ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্যেরও প্রধান নিয়ামক। পানির অপব্যবহারের কারণে যদি বিশ্ব ইকোসিস্টেমের অপূরণীয় ও অপরিমেয় ক্ষতি সাধিত হতে থাকে, তবে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের মতোই পৃথিবী নামক আমাদের প্রিয় সবুজ গ্রহটিও একসময় প্রাণহীন গ্রহে পরিণত হতে পারে।

লেখক : সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন