বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পবিত্র আশুরার শিক্ষা

আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২২, ১৩:০৬

হিজরি সনের প্রথম মাস হচ্ছে—মহরম। আর মহরমের ১০ তারিখ হলো ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল ফজিলতপূর্ণ দিন পবিত্র আশুরা। ‘মহরম’ শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাসটি কতগুলো ঘটনার জন্য উল্লেখযোগ্য এবং স্মৃতিবিজড়িত। স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা এবং মর্যাদার কারণেই মহরম মাসের গুরুত্ব অত্যধিক। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন—‘আসমান-জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে গণনায় মাসসমূহের সংখ্যা ১২টি, যা আল্লাহর কিতাবে (লাওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ রয়েছে। তার মধ্যে চারটি মাস (রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহরম) সম্মানের। এটা হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দিন।’ (সুরা তাওবাহ, আয়াত ৩৬)।

সম্মানিত এই চার মাস সম্পর্কে বান্দাকে সতর্ক করে দিয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন—‘ফালা তাজলিমু ফিহিন্না আনফুসাকুম’ অর্থাৎ এই সম্মানিত মাসসমূহে তোমরা একে অপরের প্রতি জুলুম কোরো না। হজরত ইবনে আব্বাস (রাজি.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা সব মাসেই জুলুম করতে নিষেধ করেছেন। তবে বিশেষভাবে হারামকৃত এই চার মাসে জুলুম-পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন।

ইসলামি পঞ্জিকা অনুযায়ী মহরমের ১০ তারিখ হচ্ছে পবিত্র আশুরা। এ দিনটিকে আল্লাহ বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল এই দিনকে বলা হয় পৃথিবীর আদি-অন্তের দিন। অর্থাৎ এই দিনেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে, আবার এই দিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। এই দিনটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মুসলমানদের জন্য এই দিনে রোজা রাখা ফরজ ছিল। এরপর যখন হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন এই আশুরার ১০ তারিখের রোজাটি আমাদের জন্য নফল হয়ে যায়। এই ১০ মহরমের সঙ্গে মিলিয়ে নবি করিম (স.) আমাদের আরেকটি রোজা পালন করার নির্দেশ করেন। মহরমের ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ আমরা নফল রোজা পালন করে থাকি। মুসনাদে আহমাদের এক বর্ণনায় এসেছে, নবি করিম (স.) বলেন—‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহ পাকের কাছে আমি আশাবাদী, আল্লাহ এ রোজা পালনের ফলে এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’

যে ঘটনাগুলোর কারণে আশুরা তাত্পর্যময় এবং মুসলমানদের জন্য বিশেষ শোকের নিদর্শন হয়ে আছে সংক্ষেপে সেগুলো হচ্ছে—(১) আশুরার দিনে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। আবার এই দিনেই তিনি কেয়ামত ঘটাবেন। (২) আশুরার দিনে হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ার বুকে নেমে এসেছিলেন। আবার এই দিনেই আল্লাহ পাক আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেছিলেন, এই দিনে আরাফাতের ময়দানে হওয়া (আ.)-এর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। (৩) হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির লোকজন আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিমজ্জিত হওয়ার পর আশুরার এই দিনে নৌকা থেকে ইমানদারদের নিয়ে জমিনে অবতরণ করেন। (৪) হজরত ইবরাহীম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর আশুরার এই দিনে সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন। (৫) হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর আশুরার এই দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন। (৬) হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) তার সৎ-ভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর মিশরে গিয়ে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছিলেন, দীর্ঘ ৪০ বছর পর আশুরার এই দিনে তার পিতার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। (৭) হজরত ইউনুস (আ.) আশুরার এই দিনে ৪০ দিন পর মাছের পেট থেকে নাজাত পেয়েছিলেন। (৮) আশুরার এই দিনে আল্লাহ হজরত মুসাকে (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, আর ফেরাউন ও তার দলবলকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। (৯) হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির লোকেরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করলে আশুরার এই দিনে আল্লাহ তাআলা তাকে আসমানে উঠিয়ে নেন। (১০) আশুরার এই দিনে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে নবি করিম (স.)-এর কলিজার টুকরা আদরের নাতি ইমাম হুসাইন রাজি. অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেন।

আর কারবালার এই মর্মান্তিক ঘটনা ১০ মহরম সংঘটিত হওয়ার কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ দিনটিকে স্মরণ করে নবি পরিবারের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা জাগ্রত হয়ে থাকে। ইমাম হুসাইন (রাজি.) আমাদের জন্য যে সত্যের শিক্ষা রেখে গেছেন তা দিয়ে পথ চলার প্রেরণা পেয়ে থাকি। কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তা হচ্ছে—মুসলমানদের বড় শক্তি হচ্ছে তাদের মজবুত ইমান। তাই আমাদের ইমানি চেতনায় বলীয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে জীবন পরিচালনা করতে হবে। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন রাজি. সপরিবারে আত্মত্যাগ করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়ে গেছেন যে, মস্তক আল্লাহর কাছে নত হয়েছে, সে মস্তক কখনো বাতিলের কাছে নত হতে পারে না। আল্লাহর পথে অটল থাকতে মুমিনরা কখনো তাদের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। তাই আজকের মুসলমানরা সব অন্যায়ের ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারলেই ইমাম হুসাইন (রাজি.)-এর ত্যাগ সার্থক হবে; এটাই কারবালার শিক্ষা। সর্বোপরি আমাদেরকে নবি করিম (স.)-এর আখলাক, তার আদর্শ ধারণ করতে হবে। ‘আহলে বাইত’ তথা নবি পরিবারের প্রতি হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা তৈরি করতে হবে।

লেখক: আজিমপুর দায়রা শরিফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন পির ও মোতাওয়াল্লি

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন