শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। বলা হয়ে থাকে, ‘যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত’। দেশ ও জাতির উন্নয়নের নিয়ামক বলা হয় শিক্ষাকে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত সুশৃঙ্খল হবে, শিক্ষার মান তত ভালো হবে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, গোড়া থেকে আগা অবধি গলদে ভরপুর। এমনকি শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে অনুগমনের প্রক্রিয়াও গোঁজামিলের পদ্ধতিতে দাঁড়িয়ে আছে। এ গোঁজামিলের অবসান ঘটানো অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যথায় শিক্ষার সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্যের সফলতার মুখ থুবড়ে পড়বে।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যার্জনের পীঠস্থান বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। যেখানে জ্ঞানের সত্য উচ্চারিত, উৎসারিত হওয়ার কথা সেখানেও জগাখিচুড়ি অবস্থার মধ্যে চলছে জ্ঞানার্জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্ত বুদ্ধি চর্চার জায়গায় সিলেবাস ও শিটভিত্তিক পড়াশোনা কতটুকু যুগোপযোগী? তা কেবল প্রশ্নই থেকে যায়। আবার দেখা যায়, এমন অনেক বিষয় পড়ানো হয় যার আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আমরা প্রায়শই দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসার জায়গা থাকে না। যদি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বিষয় খতিয়ে দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, কোনো না কোনো জব সিরিজের বইয়েই ডুবে আছে। শুধু যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন হচ্ছে তা নয়, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চালচিত্র ফুটে উঠেছে এর মাধ্যমে। এমনকি এ দিক দিয়ে প্রকৌশল-মেডিকেল পড়ুয়া স্টুডেন্টরাও পিছিয়ে নেই। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে বটে। যেমন, একাডেমিক পড়াশোনা চাকরি পেতে কাজে আসছে না বললেই চলে। এখানে বলা যায়, হয় একাডেমিক লেখাপড়ার পদ্ধতি ভুল, অথবা চাকরির পরীক্ষা পদ্ধতি ভুল। দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না বিধায় তারা এখন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রতিযোগিতায় অক্টোপাস গতিতে নামছে। এর জন্য শিক্ষার সঙ্গে কর্মের মূল্যায়নের সীমাবদ্ধতাই দায়ী।
বিশ্বের প্রথমসারির ১ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লিস্টে স্থান পায় না আমাদের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়! বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে বয়ে চলে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার তীব্র ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা। ফলে তারা একাডেমিক শিক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্বারোপ করছে বিসিএসের গৎ বাঁধা মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনার ওপর। শিক্ষাব্যবস্থায় বিসিএস ঝড় নেতিবাচকতা সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করছেন, বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনমুখী শিক্ষার্জনের পেছনে না ছুটে চাকরিমুখী পড়াশোনায় মনোনিবিষ্ট। এ গত্বাঁধা পড়াশোনা শিক্ষার মান কে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈ মান বৃদ্ধি করে না। যা দেশ ও জাতির জন্য অশনিসংকেত!
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক সিনিয়রদের পরামর্শ হচ্ছে এরকম যে, ‘একাডেমিক পড়াশোনা কিছুই না, দিনশেষে অর্জন বলতে চাকরির জন্য পড়াশোনাটাই’। হ্যাঁ, তাই বটে দিন শেষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য আপনার একাডেমিক ভালো ফলাফলের চেয়ে গত্বাঁধা পড়াশোনাই বেশি কার্যকর। তাহলে কেন একজন শিক্ষার্থী একাডেমিক পড়াশোনায় বেশি সময় ব্যয় করবে? খুব জটিল সমস্যা! এ থেকে উত্তরণের পন্থা অবিলম্বে খুঁজে বের করতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানের একটি আলোচিত বিষয় ‘সনদনির্ভর শিক্ষা নয়, জ্ঞানার্জনমুখী শিক্ষার নিশ্চিত করা হোক।’ সত্যি বলতে কি সমাজে এখন সনদনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাই প্রচলিত। শিক্ষার্থীরা শুধু অপেক্ষায় থাকে কখন চাকরির পরীক্ষায় বসবে। বলা যায়, শিক্ষার মূল লক্ষ্যই যেন চাকরি পাওয়া। আমাদের দেশের চাকরির জন্য মূল্যায়নটাও করা হয় সেভাবেই। চাকরিতে প্রবেশের মূল্যায়নের পদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন। কেননা, মুখস্থনির্ভর অথৈ পড়াশোনা আর যা হোক যোগ্যতা মাপার জন্য যথেষ্ট নয়।
আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ প্রতি বছর বিদেশে যাচ্ছে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে। কিন্তু চিন্তার বিষয় তাদের মধ্যে কত জন দেশে ফিরছেন! আবার যারা দেশে ফিরেছেন তাদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে কি-না এ নিয়ে কোনো তথ্য কিংবা গবেষণা আছে কি? আবার বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নেওয়া শিক্ষার্থীরা বিদেশেই স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করে এবং অনেকেই সফলও হয়। এর পেছনের রহস্য উদ্ঘাটিত হলে দেখা যাবে, তাদের দেশে যথাযথ মূল্যায়ন করার ক্ষেত্র খুবই কম। অথচ দেশে হাজার হাজার চীনা, কোরিয়ান, ভারতীয়রা চাকরি করে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে কি ভাবছে নীতিনির্ধারকেরা? চীনে উন্নয়নের জোয়ারের পেছনে অনেক বিষয় জড়িত। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে এনে যুগোপযোগী কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগানো। এর জন্য চীনা সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেমন ‘সহস্র ট্যালেন্টস হান্ট প্রজেক্ট’। এমনকি ভারত সরকারও মেধাবীদের দেশে মূল্যায়নের জন্য জোরালো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের উদাসীন মনোভাব রাষ্ট্রের জন্য অহিতকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের উচিত এ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে জোরালো ভূমিকা রাখা। অন্যথায় মেধা পাচারের রাষ্ট্রে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
যদি প্রশ্ন করা হয়, বর্তমান প্রজন্মের সরকারি চাকরির প্রতি এত ঝোক কেন? উত্তর হিসেবে যেমন চাকরির সুযোগ, সুবিধা, নিরাপত্তার বিষয় উঠে আসে, তেমনি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিও ফুটে ওঠে। সমাজের চোখে সরকারি চাকরিজীবী মানে বিশাল বড় বিষয়। আবার তা যদি হয় বিসিএস ক্যাডার তবে তা বলাবাহুল্য। সমাজের দৃষ্টিতে একজন সফল উদ্যোক্তার তুলনায় সরকারি অফিসের সহকারীর মূল্য বেশি। বেসরকারি চাকরি করে কিংবা কোম্পানিতে চাকরি করে, এমন সব বলে তাচ্ছিল্য করা হয়। এ থেকে বুঝতে পারা যায়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থান নিরাপদ, আকর্ষণীয় ও নিয়মকানুন মাফিক হওয়া প্রয়োজন।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। প্রথমত, প্রাথমিক লেভেল থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত যেমন শৃঙ্খলার আওতায় আনতে হবে তেমনি শিক্ষা শেষে কর্মে অনুপ্রবেশের পন্থাকেও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিদেশে যাওয়া মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে এনে কার্যকরী কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, নতুন যে শিক্ষানীতি প্রবর্তন করা হয়েছে তা শিক্ষার মানোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তৃতীয়ত, দেশে উচ্চশিক্ষার এত প্রতিষ্ঠান, এত শিক্ষার্থী ভর্তি না করিয়ে শিক্ষার গুণমানের দিকে নজর দিতে হবে। চতুর্থত, সরকার ইতিমধ্যে কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। তা আরো জোরালো করতে হবে। কেননা, কর্মমুখী-কারিগরি শিক্ষা বর্তমান যুগের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের উচিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিরাপত্তার বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা। এতে সরকারি চাকরির ওপর চাপ কমবে। সরকারি চাকরিকে সফলতার মানদণ্ড বিবেচনা করা, এমন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়