ঠিক যে সময়টিতে পেজা তুলার মতো শুভ্র মেঘ দক্ষিণের বাতাসে উড়ে চলার কথা, সেসময়ে পশ্চিমের কোল জুড়ে প্লাবনের ঘন কালো মেঘের সঙ্গে দিনভর বৃষ্টি। কাশফুলের ঢেউ খেলানো অপতিত জমিটি কর্দমাক্ত হয়ে শরতের চিরচেনা আবহাওয়ার অপেক্ষায়। তবে ষড়ঋতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আমাদের বাংলাদেশে এই বদলে যাওয়া কি দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ বিপর্যয়ের ফসল?
স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন, মাত্রাতিরিক্ত মনুষ্যসৃষ্ট দূষণ, জলবায়ু-অসংবেদনশীল বিল্ডিং উপাদান এবং বিশ্ব জুড়ে সবুজ বনাঞ্চলের অপরিকল্পিত নিধনের কারণেই মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব চরমে পৌঁছাচ্ছে দিনকে দিন। সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে নর্থওয়েস্ট ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির এক গবেষণা বলছে, মানুষের ক্রিয়াকলাপ, বিশেষত পরিবেশ বিপর্যয় পৃথিবীর পানিচক্রের সময়কে প্রভাবিত করছে এবং বিগত চল্লিশ বছরের ব্যবধানে ঋতুভিত্তিক বৃষ্টিপাতকে প্রায় চার দিন বিলম্বিত করেছে।
১৯৭৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের ধরন বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেন, বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ভূমি এবং সাহেল অঞ্চলের ভূমিরূপে বর্ষা মৌসুমকে উল্লেখযোগ্যভাবে বিলম্ব ঘটিয়েছে। গবেষকরা এটাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, এ শতাব্দীর শেষের দিকে বর্ষাকাল উত্তরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ভূমিতে পাঁচ দিনের বেশি এবং সাহেলের ওপর আট দিনের বেশি বিলম্বিত হতে পারে। তবে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে বিলম্বিত হয় এই বৃষ্টি?
বৃষ্টির বিলম্ব মূলত ক্রমবর্ধমান আর্দ্র বায়ুমণ্ডলের কারণে হয়ে থাকে। যখন তাপ আটকে থাকা গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলি পৃথিবীর পৃষ্ঠকে উষ্ণ থেকে আরও উষ্ণতর করে, তখন প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। মৌসুমি ও নিয়ত বাযুর দিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গ্রীষ্মকাল ক্রমাগত শীতের দিকে ধাবিত হয় এবং বৃষ্টির সুষম বিন্যাস আবহাওয়া অনুযায়ী পরিবর্তন হয়।
আবার যখন বায়ুমণ্ডলে বেশি জলীয় বাষ্প থাকে, তখন এ ধরনের বায়ু কিছুটা সমুদ্রের উপরিভাগের বায়ুর মতো আচরণ করে। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের চেয়ে মহাসাগর উষ্ণ হতে যেমন বেশি সময় নেয়, তেমনি অধিক আর্দ্রতার বায়ুমণ্ডলের শক্তি শোষণ করতে এবং বৃষ্টিপাত হতেও বেশি সময় লাগবে। পরিবেশ দূষণ বৃষ্টিপাতকে সাময়িক বা দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধও করে দিতে পারে। কারণ একটি বৃষ্টির ফোঁটা তৈরি হতে আনুমানিক প্রায় এক মিলিয়ন ছোট ছোট জলীয়বাষ্পের ফোঁটাকে অবশ্যই সংঘর্ষ এবং একত্রিত হতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসেবে মেরু অঞ্চলের বরফ গলার পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং এর ফলে বাষ্পীভবন কমে যাওয়ায় পরিবেশের আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ায় মহাসাগরের উপরিস্থ পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধিও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলাতে সাহায্যে করছে।
এছাড়া ক্লাউড সিডিং পদ্ধতিতে তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাত হয় এমন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল শুষ্ক অঞ্চলে কৃত্রিম বৃষ্টি ঘটানোর ফলে পার্শ্ববর্তী দারিদ্র্যপীড়িত শুষ্ক অঞ্চলগুলো হয়ে উঠবে আরও শুষ্ক। চিরহরিৎ বনাঞ্চলে হঠাৎ দেখা দিতে পারে তীব্র খরা। নদী শুকানোর ফলে উপকূলবর্তী অঞ্চলে স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহে দেখা দিবে বিপত্তি।
বৃষ্টিপাত বিলম্বিত হওয়ার অনেক ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। যেমন :বিলম্বিত ফসল উৎপাদনের ফলে দেশে বিদ্যমান গুদাম, হিমাগার অব্যবস্থাপনা, সঠিক সময়ে বৃষ্টির অভাবে চারা ও বীজ নষ্ট করে বৃষ্টি মৌসুমে সংকটের সৃষ্টি, তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে জনজীবনে অস্বস্তি, অনিয়ন্ত্রিত দাবানলে ফসল ও ঘরবাড়ি নষ্ট হওয়া ইত্যাদি।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়