বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। ভারত বাদে একমাত্র মিয়ানমারের সঙ্গেই বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে আরো চারটি দেশের ভৌগোলিক সীমান্ত রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে— ভারত, চীন, লাওস ও থাইল্যান্ড। মিয়ানমারের আন্তঃরাজনৈতিক সংকটের কারণে এসব দেশের সীমান্ত অঞ্চলগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিকভাবে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে চীনের প্রতি এই সংকটের প্রভাব না পড়লেও পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত এবং থাইল্যান্ডের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য বিষয়টি খুবেই উদ্বেগজনক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংকটের কারণে সীমান্ত নিরাপত্তা, উগ্র-সন্ত্রাসবাদী তত্পরতার সমাধান, শরণার্থী সমস্যার সমাধান এবং আঞ্চলিক কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের সীমান্তেও।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের বর্বরোচিত জেনোসাইডের শিকার হয়ে প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে এবং কক্সবাজার সীমান্তের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস ও বিদ্রোহীদের দমন করার অজুহাতে বারবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে এবং এমনকি তাদের সামরিক বিমান বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।
একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরে অন্য দেশের সামরিক বাহিনী প্রবেশ করা সেই দেশটির সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বর্ডারের কাছে কোনো সৈন্য সমাবেশ করলে অপর দেশকে কারণসমূহ অবহিত করতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মিয়ানমার বারবার তাদের ধৃষ্টতা দেখিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে বান্দরবানের ঘুমধুম এলাকায় দুইটি মর্টার শেল এসে পড়ে। অভিযোগ ওঠে, মিয়ানমারের দিক থেকে ঐ দুইটি মর্টার শেল ছোড়া হয়েছে। এই ঘটনার পর মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে ‘নোট ভার্বালের’ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। মিয়ানমার সরকার আশ্বাস দেয় যে, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল আর হবে না ভবিষ্যতে। কিন্তু সীমান্তে মর্টারশেল ও গোলা বর্ষণের রেশ কাটতে না কাটতেই ১৬ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর স্থলমাইন বিস্ফোরিত হয়ে বাংলাদেশের এক যুবক গুরুতর আহত হয়েছে।
সীমান্তে বারবার মিয়ানমারের ধৃষ্টতা এবং উগ্র আচরণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের শামিল। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় কী হবে এবং কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মিয়ানমারের এমন আচরণ নিবৃত্ত করা সম্ভব—এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমার সরকারকে অভিযোগ করার পরেও যেহেতু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে তারা; কাজেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কোয়ার্সিভ ডিপ্লোম্যাসি (Coercive Diplomacy) গ্রহণ করবে কি না, বা এই পরিস্থিতিতে কোয়ার্সিভ ডিপ্লোম্যাসি গ্রহণ করা জরুরি কি না, তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। কোয়ার্সিভ ডিপ্লোম্যাসি হচ্ছে হুমকিমূলক কূটনৈতিক পরিভাষা। আলোচনার ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে, কূটনীতিকদের কখনো কখনো দাবি পূরণ না হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো ।
যুদ্ধ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একটি দেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি হলে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য প্রতিপক্ষের দাবির কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত বা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়া উচিত—কোয়ার্সিভ ডিপ্লোম্যাসির বিষয় মূলত এটিই? কোয়ার্সিভ ডিপ্লোম্যাসি বস্তুত একটি সামগ্রিক সংকট ব্যবস্থাপনার কৌশল, যা এই দ্বিধাকে মোকাবিলা করার জন্য এবং নীতিনির্ধারকদের সংকটকালীন স্বল্পসময়ে পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সমঝোতার মাধ্যমে সংকট সমাধান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ। মিয়ানমার যে প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ শুরু করেছে, তাতে আমাদের প্রতিবাদ জানানোর ভাষা একটু কড়া হওয়া উচিত বইকি। আমাদেরও চোখে চোখ রেখে বুঝাতে হবে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশও ছাড় দেবে না বিন্দুমাত্র।
মিয়ানমার যেহেতু একটি উগ্র দেশ, তাই আমাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত সাবধানতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের নীতিনির্ধারক ও কূটনীতিকদের মনে রাখতে হবে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি যাতে আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয়। কারণ আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্ট করে ফায়দা লুটতে চাইবে অনেক স্বার্থান্বেষী মহল। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকলেও আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যুদ্ধ পরিস্থিতি এড়িয়ে চলছে। এই ধরনের শান্তি পরিস্থিতি বজায় থাকলে তাদের কূটকৌশলের রশিতে টান পড়বে। উপরন্তু মনে রাখতে হবে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করবে অনেক মহল। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে সব সময়। বাংলাদেশের চিয়ায়ত পররাষ্ট্রনীতিও সে কথাই বলে।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়