আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী—চর্যাপদে ভুসুকু পা-এর এই বিখ্যাত লাইনটি বর্তমানে আমাদের নারীদের জন্য খুবই প্রযোজ্য। শুধু নারী হওয়ায় গণপরিবহনে চলাচল তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। রাস্তায় তার সম্ভ্রম এবং জীবন দুইই বেশ অনিরাপদ। গত দুই মাসে প্রায় কাছাকাছি সময়ে ঘটা কয়েকটি ঘটনা খেয়াল করলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।
৪ আগস্ট ২০২২ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেসে বাসে ডাকাতি করতে আসা ডাকাতরা বাসের এক নারীকে গণধর্ষণ করে। সেই নারীর ভাষ্যমতে, তাকে উক্ত সময়ে ছয় বার ধর্ষণ করা হয়।
তার ঠিক দুই দিন আগেই ৬ আগস্ট ২০২২ গাজীপুরে তাকওয়া পরিবহনের বাসে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হলো এক নারী পোশাককর্মী। ভুক্তভোগী নারী জানান, তার স্বামীকে মারধর করে নামিয়ে দিয়ে তাকে গণধর্ষণ করা হয়। তবে পরিবহনে এ রকম ঘটনা নতুন নয়। ২০২০ সালে গাজীপুরে চকলেট বিক্রেতা এক কিশোরীকে গণধর্ষণ করা হয়।
কেউ কেউ হয়তো প্রাণে বেঁচে যান; ধর্ষণের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাকিটা জীবন অতিবাহিত করেন। কিন্তু কারো কারো জীবনটাও আর টেকে না। ২০১৭ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর ঘাড় মটকে হত্যা করে পাশের জঙ্গলে লাশ ফেলে যায় পরিবহন শ্রমিকরা।
ধর্ষণ ছাড়াও গণপরিবহনে নারী যাত্রীর জন্য যৌন হয়রানি এক তিক্ত সত্য। প্রায়শই নারীকে এই সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। কিছুদিন আগেই রাজধানীর আজিমপুরে বিকাশ পরিবহনের বাসে এক নারী যাত্রীকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করে বাসচালকের সহযোগী। চালক ও সহযোগীর হাত থেকে বাঁচতে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন সেই তরুণী।
২০১৮ সালে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে বাসে যৌন হয়রানির চেষ্টা করা হয়। বাসচালক ও সহযোগীকে ধাক্কা মেরে ফেলে বাস থেকে নেমে যান সেই তরুণী। রাইড শেয়ারিংয়ে চলাচল কিছুটা নিরাপদ মনে করা হলেও সেখানেও অপ্রীতিকর ঘটনা কম নয়।
২০২১ সালের ১২ মে রাইড শেয়ারিং উবারের চালকের বিরুদ্ধে অশালীন আচরণ ও যৌন হয়রানির বিষয়ে মিরপুর থানায় জিডি করেন এক নারী। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দু-একটি ঘটনা সাড়া ফেললেও নারীদের সঙ্গে ঘটা এই অন্যায়গুলোর সংখ্যা শিউরে ওঠার মতোই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমীক্ষা বলছে, ২০১৬-১৯ এই চার বছরে গণপরিবহনে ১৩৪টি ধর্ষণ হয়েছে যার ৪২টিই দলবদ্ধ ধর্ষণ। যৌন হয়রানি হয়েছে ৯১টি। আঁচল ফাউন্ডেশনের করা এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, গণপরিবহনে ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ নারীই যৌন হয়রানির শিকার। আর একাকী চলার সময় যৌন হয়রানির শিকার হন ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ নারী। সংখ্যাগুলো স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ সৃষ্টি করে। তবে ঘটনার কতগুলো সংখ্যায় রূপান্তরিত হয় সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। গাজীপুরের শিল্প এলাকার এক অসহায় পোশাককর্মী তার সঙ্গে ঘটা হয়রানির প্রতিকার পাওয়ার জন্য আদৌ থানায় জানান কি না অথবা সাধারণ ছাত্রীটি লোকলজ্জার ভয়ে যৌন হয়রানির কতটুকু প্রকাশ করেন, তার সঠিক হিসাব কি কখনো পাওয়া যায়?
বর্তমানে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র উভয় জায়গাতেই বাংলাদেশি নারীরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইসের) হিসাব অনুযায়ী প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে নারী শিক্ষার্থী ৫১ শতাংশ। মাধ্যমিক স্তরের ৫৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই নারী। অর্থনীতির তিনটি বৃহত্তর খাত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। দেশের পোশাকশিল্পের ৮০ শতাংশ শ্রমিকই নারী। নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার-সমতা নির্ধারণে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি অর্জনে কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সম অংশীদারিত্ব বলবৎ থাকা প্রয়োজন।
আর এসব কিছুর জন্য নারীদের নিরাপদ চলাচলকে নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যেই বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নারী ও প্রতিবন্ধীদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য গণপরিবহনে ৯টি আসন সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা আগেই গৃহীত হয়েছে। সড়কপথের নিরাপত্তায় ২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশ গঠন করা হয়েছে। মানুষকে সচেতন করতে বিআরটিএ মাঝেমধ্যে জাগরণমূলক লিফলেট বিলি করে।
সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ২০১৮ সালে মহান জাতীয় সংসদে দেওয়া এক বক্তব্যে বলেছেন, গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হলে সেই গাড়ির রুট পারমিট বাতিল করা হবে।
গত ২রা জুন বেসরকারি উদ্যোগে ‘দোলনচাঁপা’ নামে মহিলা বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এই ধরনের বাসের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা দরকার। সব কটি বিভাগীয় শহরসহ দেশের বড় শহরগুলোতে এই সেবাকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
তবে গণপরিবহনের প্রধান ক্রীড়ানক হলেন পরিবহন শ্রমিকরা। এজন্য পরিবহন শ্রমিক নিয়োগের সময় নিয়োগপত্র চুক্তি করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিয়ে ডাটাবেজ প্রস্তুত করা প্রয়োজন। গাড়ির ফিটনেস এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান এবং নবায়নের সময় নারীর প্রতি সহিংসতা রোধসংক্রান্ত কোনো মডিউল বা অঙ্গীকারনামা রাখা যেতে পারে। অধীনস্থ কর্মচারীর কোনো অপরাধের জন্য বাসমালিকদেরও আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরো কঠোর করা প্রয়োজন। গণপরিবহন হাবগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সিসিটিভি এবং পর্যায়ক্রমিক নজরদারির ব্যবস্থা নিতে হবে। নৈতিক ও মূল্যবোধ শিক্ষা ও জেন্ডার শিক্ষায় গণপরিবহনে নারীর প্রতি আচরণসংক্রান্ত পাঠ অন্তর্ভুক্তি করা প্রয়োজন।
২০২০ সালে বেগম রোকেয়া দিবসে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘বাংলাদেশকে অবিচার থেকে সুবিচারের ধারায় ফেরাতে কাজ করছে সরকার। নারীদের পেছনে ফেলে সমাজের অগ্রগতি অসম্ভব।’ সেই প্রত্যয় থেকেই বলতে হয়, নারীদের চলার পথ কণ্টকাকীর্ণ না হোক। ‘আঁধার তবু মুখ ঢাকে তার চাদরখানার ভাঁজে, রাত্রি পোহায় না যে কবি’—সিকান্দার আবু জাফরের ‘তখন রাত্রিশেষ’ কবিতার এই লাইন দুটির মতো আমাদের নারীদের অগ্রযাত্রা না হোক, তাদের পথের আঁধার দূরীভূত হোক। তারা যেন নির্বিঘ্নে সর্বত্র যাতায়াত করতে পারে সেজন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত উভয় পর্যায়ের দৃপ্ত শপথ সমুন্নত থাকুক।
লেখক: এম ফিল গবেষক আইইআর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজসেবা অফিসার, সমাজসেবা অধিদপ্তর, বরিশাল।