শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হকার পুনর্বাসন জরুরি 

আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:৫৭

আমরা জানি, ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক ঢাকা নগরী বেড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। এই অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নগরীকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর রূপরেখা নিয়ে কাজ করছে সরকার। তাই ঢাকাকে যুগোপযোগী আধুনিক এবং রাজধানীর ভেতর যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যে হকারমুক্ত নগরী করা প্রয়োজন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি হকার রয়েছে এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই হকার নিয়ম মেনে ব্যবসা করে। অথচ আমাদের দেশের  হকাররা কোনো নিয়ম মানে না, তারা ফুটপাত রাস্তা দখল করে ব্যবসা চালায়। যার প্রেক্ষিতে আমাদের দেশে চলে হকার উচ্ছেদ অভিযান এবং সম্প্রতি আবারও ডিএনসিসি হকার উচ্ছেদের কাজ শুরু করেছে।

রাজধানী ঢাকা হলো বসবাসের জন্য অযোগ্য শহর, যা বিভিন্ন বৈশ্বিক জরিপে উঠে এসেছে। ঢাকার যানজটের কথা আমরা প্রত্যেকেই জানি এবং এই যানজট সৃষ্টির জন্য হকারদের দায়ী করা হচ্ছে; কিন্তু যানজট সৃষ্টির জন্য যে শুধু তারা দায়ী বিষয়টা ঠিক না। ঢাকার যানজটের প্রধান কারণ হলো রাস্তার সংকট। তবে এটাও সত্য, সাধারণত হকাররাই ফুটপাতগুলো দখল করে রাখে। এজন্য ফুটপাতগুলো হকারমুক্ত রাখা দরকার।

রাজধানীর ভেতর যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থনীতির জন্য জরুরি; কিন্তু ঢাকার বেশির ভাগ ফুটপাত হকারদের দখলে। ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। হকাররা ফুটপাতে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে থাকে। যার ফলে যাতায়াতের যথেষ্ট সমস্যা হয় পথচারীর। রাস্তা-ফুটপাত হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় এর চরম মূল্য দিচ্ছে সাধারণ নগরবাসী। যানজটের কবলে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে স্কুলে যেতে পারে না। চাকরিজীবীরা যথাসময়ে কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারছেন না। আর ফুটপাতে স্বাভাবিক হেঁটে চলার তো কোনো উপায়ই নেই।

রাজধানীতে হকার বা ফেরিওয়ালা অতি পরিচিত মুখ। এখনো আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। তাদের বাঁচতে হয় সংগ্রাম করে। সাধ্যের মধ্যে তাদের সাধ পূরণ করতে হয়। কেননা নামিদামি দোকানগুলো থেকে পণ্য কেনার সামর্থ্য তাদের থাকে না। তখন তাদের একমাত্র ভরসা হকার বা ফুটপাতে যারা পণ্য বিক্রি করে। বিভিন্ন কাজে যাতায়াতের সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণি পথ চলতে প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস কেনাকাটা করেন ফুটপাত থেকে। কম টাকায় নিজেদের পছন্দমতো জিনিস ক্রয় করতে পারে জনসাধারণ ও তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করে পেট চলে এসব হকারদের। তাদের দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয় না বলে পণ্যের মূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়ে না। ফলে এ উচ্চমূল্যের বাজারে ও নিম্নমধ্যবিত্তরা কেনাকাটার জন্য হকারদের ওপর নির্ভরশীল।

রাস্তায় অল্প বয়সের কিশোর হকাররা গলায় বাক্স বা ট্রে ঝুলিয়ে বিভিন্ন জিনিস ফেরি করে। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা বইখাতা, সে বয়সে তুলে নিয়েছে একটি সংসারের দায়িত্ব। যার ফলে তার পরিচয় ছাত্র না হয়ে হকার হয়েছে। হকাররা যা করে তা তাদের বেঁচে থাকার জন্য। তারাও দেশের অর্থনীতির অংশ। মূলত বেকারের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতেই তারা আজ হকার। কেউ শখ করে বেছে নেয় না এই পেশা। তারা হকার ! খুব ভালো জীবনযাপন করার সাধ্য নেই তাদের। মাঝেমধ্যে আধপেটা, আবার কখনো কখনো, না খেয়েও দিন কাটাতে হয় তাদের। রাজধানী দখলমুক্ত ও যানজটমুক্ত হোক, এটা সবার-ই চাওয়া। কিন্তু যারা হকারি করছে, তারাও এদেশের নাগরিক, তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। তাদের পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদ করা অমানবিক এবং জোর করে উঠিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। স্বাধীনতাপূর্ববর্তী ১৯৫২ সালে এবং স্বাধীনতাপরবর্তী ১৯৭৯ সালেও বাস্তবায়ন করা হয় দুটি প্রকল্প। এছাড়াও হকারদের পুনর্বাসনের জন্য মার্কেট করা হচ্ছে; কিন্তু সে স্থানে হকারদের মার্কেট পুনর্বাসন করা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গেই খালি হওয়া স্থানগুলোতে দ্বিগুণ হকার জোগাড় হয়। চাঁদা তোলা বন্ধ না হলে পুনর্বাসন করলেও হকারদের কোনো উপকার হবে না। হকারদের জন্য বরাদ্দকৃত দোকানগুলো বেশির ভাগ প্রভাবশালীরা বরাদ্দ পান। আবার হকাররা সালামির টাকা জমা না দিতে পেরে বরাদ্দের কাগজগুলো বিক্রি করে দেয়। ফলে ছিন্নমূল হকাররা দোকানের প্রকৃত মালিক হতে পারে না। যার ফলে পুনর্বাসন করেও তাদের  উপকার হয়নি । 

বেকারত্ব নিরসন, দারিদ্র্যদূরীকরণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে হকারদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ছিন্নমূল এসব মানুষকে যদি ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তবে তাদের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কলকাতার মতো একটি বৃহৎ নগরীকে  সুস্পষ্ট নীতিমালা এবং সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে হকার সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। কিন্তু আমরা অবহেলিত হকার শ্রেণির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও পুনর্বাসন করতে পারছি না। উচ্ছেদকৃত হকারদের পুনর্বাসন জন্য মার্কেট করা হলেও সবাইকে দোকান দেওয়ার সম্ভব হয় না। কারণ প্রচুর হকার্স করার মতো স্থান ও অর্থ আমাদের নেই। রাজধানীতে কোনো লোক জীবিকার জন্য এসে যেন হকারি করতে না হয়। অর্থাৎ নতুন হকারের সংখ্যা যেন বৃদ্ধি না পায়, এজন্যে দেশ জুড়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। মোটকথা, হকারদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। রাজধানীতে হকার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নতুনরূপে সাজাতে হবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নগর-মহানগরগুলো। 

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন