রাজধানীর ফুটপাত, ফ্লাইওভার, বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশনে আশ্রয় নেওয়া ছিন্নমূল বা ভাসমান মানুষরা রাত বাড়লে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। আর দিনের আলোয় ওরা ‘টোকাই’। রাত হলেই গাড়ির অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয় এই টোকাইবেশী ছিনতাইকারীরা। এমনটিই জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা।
আইন-শৃংখলা বাহিনী বলছে, শুধু টোকাই বেশে নয়। রাজধানীজুড়ে ছিনতাইয়ের কৌশল হিসেবে ছিনতাইকারীরা ভ্যানে করে সবজি বিক্রেতা, ভাঙারি মালামাল ক্রয়ের বেশ ধরে ছিনতাইয়ের ছক আঁকে। পরে রাতের অন্ধকারে সুযোগ বুঝে ছিনতাই করে এরা।
সূত্র বলছে, সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেও জামিনে বের হয়ে ফের একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে তারা। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড়ে শেওড়া, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর, আজমপুর, আব্দুল্লাহপুরসহ বিভিন্ন স্থানে দিনে টোকাই আর রাতে ভয়ংকর ছিনতাইকারী হয়ে ওঠে এরা। ভুক্তভোগী শামীম ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘ট্রেনে রংপুর যাবো। অনেক আগে থেকে ফলো করছিল একজন। কিন্তু বুঝতে পারিনি তখন। ঠিক উঠার সময় গেটের সামনে অনেক জটলা। উঠে সিটে গিয়ে দেখি আমার মোবাইল নেই। বুঝতে পারলাম তাহলে চুরির উদ্দেশে এমন করছিল তারা।’ বিমানবন্দর রেলস্টেশনের এক ফাস্টফুড ব্যবসায়ী জানান, ‘এরা টোকাইয়ের বেশ ধরে থাকে। অনেক সময় কাস্টমারের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এরা সারাদিন ট্রেনের এ-বগি ও-বগিতে দৌড়াদৌড়ি করে। রাত হলেই অঘটন ঘটায়। এদের কাজই হলো ছিনতাই করা।’
একজন টোকাইবেশী সাদ্দাম (ছদ্মনাম)। জন্মের পর থেকেই বেড়ে উঠেছে কমলাপুর স্টেশনের ফুটপাতে। ১২ বছর বয়সী সাদ্দাম জানায়, বোতল টোকাইয়া, ব্যাগ টাইন্যা যা পাই হেইড্যা দিয়া ভাত খাই। সহজে কেউ ব্যাগ দিতে চায় না, যদি চুরি কইর্যা লইয়্যা যাই তাই। অ্যামগো দেইখ্যা হগ্গোলেই দুরে ঠেইল্যা দেয়। পেটের ভাত আর নেশার ট্যাহা জোগাতেই ছিনতাই করতে বাধ্য হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দিনের আলোতে এই শিশুরা আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের সামনে প্রকাশ্যে ধূমপান, গাঁজা ও নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করছে। বিমানবন্দর স্টেশনের এপিবিএন পুলিশের গেটের বিপরীতে প্ল্যাটফর্মের পাশে অনেকটা নির্জন এলাকা। সেখানে ৫ থেকে ৬ জন জটলা করে গাঁজা, সিগারেট ও পলিথিনে ড্যান্ডি সেবন করছেন। আবার ছিনতাই করে সেখানেই আশ্রয় নেয় তারা।
তোমরা নেশা করছো কেন? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে এক টোকাই জানায়, অ্যামগো তো মা-বাপ কেউ নাই, কেড্যা কী কইব। অ্যামগো বাড়ি ঘড় সবই তো স্টেশন। এটা অ্যামগো লাগবই। নেশা ছাড়া আর কি আছে অ্যামগো। অন্য এক শিশু জানায়, দিনে বোতল টোকাইয়া বিক্রি করি। রাত হলে যাত্রীদের ব্যাগ নিয়ে পালাই। আবার রাত হলে রাস্তায় যাইয়া গাড়ি থ্যাইকা মুরগি, কাঁচা সবজি, নামাইয়া বিক্রি করি। আর কি শুনতে চান বলেন?।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনের বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের সেচ্ছাসেবী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যেখানে এসব শিশুদের থাকার কথা পরিবারের সঙ্গে। বড় হয়ে উঠার কথা ছিল একটি সুন্দর পরিবেশে আনন্দ-উল্লাসে। অথচ জন্মের পর থেকেই এরা ফুটপাত, বস্তি, রেলস্টেশনে। তাদের হাতে বই-খাতা না উঠে, উঠেছে নেশা নামক ভয়ানক দ্রব্য। একটুখানি আদর-যত্ন ও মা-বাবার ভালোবাসা পেলেই হয়ত তারা হতে পারত জাতির ভবিষ্যৎ।
কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘ রেলওয়ে পুলিশ তাদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন ধরনের আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যাদের বয়স কম তাদেরকে কিশোর অপরাধ থেকে দূরে রাখার জন্য এনজিওর মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’
এ বিষয়ে উপপুলিশ কমিশনার (উত্তরা বিভাগ) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, ‘রাস্তায় ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে সবসময় আমাদের পুলিশ সদস্য সজাগ থাকে এবং তাদের আটক করে থাকে। যাদের বয়স কম তাদের বিভিন্ন কিশোর অপরাধ সংশোধনাগারে পাঠায়। এছাড়া সমাজের বিত্তবানদের এবং এনজিওগুলো এগিয়ে আসলে কিশোর অপরাধ থেকে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব।’