শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইসলামপুরে বাল্যবিয়ের ছড়াছড়ি

আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২২, ১২:০৮

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে এখন বাল্যবিয়ের ছড়াছড়ি। স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় বাল্যবিয়ে যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা যায়, উপজেলার গাইবান্দা, কুলকান্দি, বেলগাছা ও সাপধরি ইউনিয়নের বিভিন্ন চরাঞ্চলে করোনার পরবর্তী বাল্যবিয়ে চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে গাইবান্দা ইউনিয়নের চরদাদনা পূর্ব ও পশ্চিমপাড়া, বটচর, পোড়ারচর কান্দারচর, গংগাপাড়া ও নাপিতেরচর এলাকায় বাল্যবিয়ের ছড়াছড়ি।

এছাড়া উপজেলার কুলকান্দি ইউনিয়নের হরিণধরা ও চরবেড়কুশা, বেলগাছা ইউনিয়নের মুন্নিয়ারচর, সিন্দুরতলী, শিশুয়া এবং সাপধরি ইউনিয়নের চরচেঙ্গানিয়া, চর শিশুয়া, কালিরচর ও চরবিশরশি যমুনার দ্বীপচরগুলোর বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাল্যবিয়ে যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়া পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সের কোমলমতি ছাত্রীদের বাল্যবিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গাইবান্দা ইউনিয়নের আব্দুস ছাত্তার উচ্চ বিদ্যালয় এবং পোড়ারচর এস এম এ দাখিল মাদ্রাসার বেশ কয়েকজন ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে।

এসব কোমলমতি শিক্ষার্থী যেন মা-বাবার বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে! যে সময় তাদের স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে কিংবা বই-পুস্তক হতে নিয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের কথা, সে সময় অভিভাবকরা শিশুমনা মেয়েদের বিয়ের নামে তুলে দিচ্ছেন দিগুণ বয়সি স্বামীর হাতে।

এসব বাল্যবিয়ের অন্যতম একটি কারণ হলো ছেলেপক্ষের যৌতুক লোভ। এছাড়া মেয়েপক্ষ সামান্য যৌতুক কিংবা বিনা যৌতুকে স্বামীর ঘরে তুলে দিতে পারলেই যেন বাঁচে!

এসব শিশুকন্যার স্বামীর সংসার সাময়িক সুখের হলেও পরবর্তীতে দুই-একটি সন্তান হলেই নেমে আসে অশান্তির ঢেউ। অনেক স্ত্রী বেছে নেয় আত্মহণনের পথ। বর্তমান সরকার বাল্য বিয়ে/বহুবিবাহ নিরোধকল্পে কঠোর অবস্থানে থাকলেও সেদিকে কর্ণপাত করছেন না কন্যার পরিবার।

পোড়ারচর এস এম এ দাখিল মাদ্রাসার সুপার মৌলনা আনিছুর রহমান তার প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ছাত্রীর বাল্যবিয়ের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমি শিক্ষার্থীর পিতা-মাতাকে অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু তারা গোপনে রাতে মেয়ের বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠিয়েছেন।

আব্দুস ছাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নজরুল ইসলামের কাছে তার প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের বাল্যবিয়ের কথা জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, 'আমি কিছু জানি না।' বাল্যবিয়ে যাদের হয়েছে, তারা বিদ্যালয়ে আসে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ক্লাস শিক্ষক মিস্টার আব্দুর রহিম বলতে পারবেন।'

ক্লাস শিক্ষক আব্দুর রহিম বলেন, অনেক দিন ধরে ওইসব শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত রয়েছে।

এদিকে সচেতন এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে কাজী মূল নিকাহ রেজিস্ট্রার নিবন্ধন না করে লুজ সিটে বর-কণের বিবরণ লিখে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। পরবর্তীতে মেয়ের বয়স পূর্ণ হলে কাবিনের কাগজ অভিবাবকদের কাছে সরবরাহ করে থাকেন।

গাইবান্দা ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী শফিকুল ইসলাম লাল মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, অপ্রাপ্ত বয়সের মেয়েদের পিতা-মাতারা নোটারী পাবলিক করে বয়স বাড়িয়ে এনে বিয়ে দিচ্ছেন। এতে আমার করার কিছুই নেই।

এসব বাল্যবিয়ে আপনি রেজিস্ট্রি করেছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বিয়ে না পড়াতে চাইলেও কাজী এসে গোপনে বিয়ে পড়ায়।

১০ নং গাইবান্দা ইউপির চেয়ারম্যান মাকছুদুর রহমান আনসারী বলেন, সরকারি পরিপত্রে জন্ম নিবন্ধনে মেয়ে ১৮ বছর এবং ছেলে ২২ বয়সের নিচে কোনক্রমেই বিয়ে দেওয়া যাবে না। ইউনিয়নের সকল কাজীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে, বাল্যবিয়ের গ্যারাকলে পড়া শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে করতে বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সম্মানজনক কর্মে যুক্ত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। কিন্তু সে আশা পুরণ হলো না। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে পিতা-মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

ইত্তেফাক/এসকে