শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

খেরসন অঞ্চল থেকে রাশিয়ার পিছুটান কতটা তাৎপর্যপূর্ণ

আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২২, ০৪:৩৩

রাশিয়ান বাহিনীর পশ্চাদপসরণের ঘটনায় ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খেরসনে আনন্দ-উল্লাসের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী যখন খেরসনের দিকে একপ্রকার বিনা বাধায় এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে ইউক্রেনের সর্বস্তরের জনতা। ইউক্রেনীয়দের এতটা জয়োল্লাসের কারণ, রাশিয়ার দখলকৃত আঞ্চলিক রাজধানীটি ফিরে পেয়েছে যুদ্ধকবলিত ইউক্রেন।

গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পুতিন বাহিনী বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে ইউক্রেনের যে চারটি অঞ্চল রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করে, খেরসন তার মধ্যে একটি। শহরটির পুনরুদ্ধার ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল। দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীরাঞ্চলে রাশিয়ান সৈন্যদের পিছু হটার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত শহরটির দখল নিতে সক্ষম হয় ইউক্রেনীয় বাহিনী।

বলা বাহুল্য, তাৎপর্যপূর্ণ খেরসন অঞ্চল বেহাত হওয়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় ধাক্কা। এই অপমান, লজ্জা খেপাটে পুতিনকে বেসামাল করে তুলেছে—এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। খেরসন থেকে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে পুতিনের সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক মুহূর্ত। সত্যিকার অর্থেই সবার মুখে এখন একটাই কথা—এটা ঠিক কী ঘটল!

রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং ইউক্রেনে নিযুক্ত রাশিয়ান কমান্ডার জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক ‘পরিকল্পিত’ বৈঠকের পর খেরসন থেকে রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। সৈন্য প্রত্যাহার আদেশ প্রচার করা হয় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায়। ঠিক এর পরই আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে ইউক্রেনের জনগণ। ইউক্রেনীয়দের এত বেশি খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি। খেরসন এমন একটি অঞ্চল, যার বেশ গুরুত্ব রয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের জন্যই। এ কারণে আক্রমণের প্রথম দিনেই শহরটির দখল নেয় পুতিন বাহিনী। তাছাড়া এই অঞ্চলে ইউক্রেনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেরা জমি রয়েছে, আছে বেশ কিছু বড় আকারের খামার। অর্থাৎ, রাশিয়ান সৈন্যরা খেরসন ছেড়ে যাওয়ার ফলে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ইউক্রেন পুনরুদ্ধার করে, যা ইউক্রেনের জন্য ছিল বহুল প্রত্যাশিত।

সেনা প্রত্যাহারের ঘটনায় রাশিয়ার ভেতরে-বাইরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। সুরোভিকিন অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, সেনা সরিয়ে নেওয়ার ফলে বেসামরিক জনগণের পাশাপাশি রক্ষা পাবে বহু রুশ সেনার জীবন। যুদ্ধের ময়দান দাপিয়ে বেড়ানো এই রুশ কমান্ডারের এ ধরনের কথা বলার কারণ বেশ স্পষ্ট। যেহেতু শুরু থেকেই খেরসন ইউক্রেনীয় বাহিনীর টার্গেটে ছিল, তাই রাশিয়ান সৈন্যশিবিরগুলো ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি রুশ সেনাদের গোলাবারুদ সংরক্ষণাগার এবং সেনাছাউনি লক্ষ্য করে ইউক্রেনীয় বাহিনী আক্রমণের ‘অতি ঝুঁকি’ তৈরি করে। তাছাড়া ইউক্রেনের সেনারা সরবরাহ লাইনগুলো ধ্বংস করে দিলে এই অঞ্চলে রুশ সেনাদের কাছে যুদ্ধ সরঞ্জাম এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছানো রাশিয়ার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, বলা যায়, বেশ খানিকটা বেকায়দায় পড়েই সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় রাশিয়া।

এখন প্রশ্ন হলো, রাশিয়া হঠাত্ সৈন্য প্রত্যাহারের মতো সিদ্ধান্তে গেল কেন? দেখার বিষয়, ‘সম্পদ সংরক্ষণ এবং অন্যান্য এলাকায় মোতায়েনের জন্য সেনাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে’—রাশিয়ার এমন যুক্তির আড়ালে একগুঁয়ে পুতিনের অন্য ফন্দি আছে কি না। রাশিয়ান কমান্ডাররা একে পুতিনের ‘বিচক্ষণ সামরিক পদক্ষেপ’ হিসেবে অবলীলায় অবিহিত করছেন, কিন্তু এর পেছনে সুনির্ধারিত কারণ থাকতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভুলে গেলে চলবে না, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে খেরসন অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করেন পুতিন। এজন্য পুতিনকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু অকস্মাৎ প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ইউক্রেনের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কারণ কী!

খেরসন অঞ্চলের প্রায় ৬০ শতাংশ এখনো রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। খেরসন থেকে পালিয়ে রাশিয়ান বাহিনী এখন দিনিপ্রো নদীর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং আজভ সাগরের উপকূলে ঘাঁটি গেড়েছে। স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যায়, এই এলাকায় তারা শক্তিশালী পরিখা খনন করেছে। এমনকি নদীর নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসরত লোকজনকে সরিয়ে দিয়েছে রাশিয়ান সেনারা। মজার ব্যাপার হলো, এই অঞ্চলে টিকে থাকাও পুতিন বাহিনীর জন্য বেশ মুশকিল হয়ে উঠবে। কেননা, উভয় বাহিনীর আক্রমণ ও পালটা আক্রমণের কারণে এতদঞ্চলে অচলাবস্থা তৈরি হবে। এর ফলে ক্রিমিয়ায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের মূল রুট তথা দিনিপ্রো নদী যুদ্ধকবলিত হয়ে পড়বে, যা সন্দেহাতীতভাবে রাশিয়ার জন্য হয়ে উঠবে মহা সমস্যা।

যা হোক, সেনা প্রত্যাহারের ঘটনা নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে মস্কোয়। অনেকে একে অপমানজনক ও বিব্রতকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দুঃখ প্রকাশ করেছেন বহু রাশিয়ান। তবে যারা আগে থেকেই পুতিনের অযাচিত যুদ্ধের সমালোচনা করে আসছিলেন, তারা এই পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। যেমন—চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ বলেছেন, ‘সুরোভিকিন ১ হাজার সেনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। অর্থহীন বলিদান থেকে সেনাদের অমূল্য জীবন বাঁচানোর এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন।’

খেরসন ছেড়ে রাশিয়ান সেনাদের পলায়নের পর এখন দেখার বিষয়, ইউক্রেন যুদ্ধ ঠিক কোন দিকে মোড় নেয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইতিমধ্যে এ ঘটনাকে ‘ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি আপ্লুত কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের দেশের দক্ষিণকে ফিরে পেয়েছি, আমরা খেরসনকে ফিরে পেয়েছি।’ দেশের মাটিকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করতে পারার এই উচ্ছ্বাস শুধু জেলেনস্কি কেন, কারো জন্যই আদৌ বাড়াবাড়ি নয়—এ কথা বলাই যায়।

এখন দেখার বিষয়, সামনের দিনগুলোতে কী ঘটে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর এই সাফল্য ইউক্রেনীয় সেনাশিবিরে উত্সাহ বাড়িয়ে দিয়েছে স্বভাবতই। এই সাফল্য ইউক্রেনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। খেরসনের সাফল্য ক্লান্ত ইউক্রেনীয় বাহিনীর মনে যে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে, তাতে ইউক্রেনীয় সেনাদের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে দনবাস অঞ্চল। এই অঞ্চলের লুহানস্ক ও দোনেস্ক দুই বাহিনীই প্রচণ্ড লড়াইয়ে লিপ্ত। এখানকার লড়াইয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ মজুত করা হয়েছে। কিছুদিন আগে মস্কো থেকে পাঠানো হয় হাজার হাজার নতুন সৈন্য।

ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের এখন প্রধান কাজ হচ্ছে খেরসন পুনর্গঠন। মূলত এটি একটি বিশাল কাজ। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। রাশিয়ান বাহিনী শহরটির গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করেছে। প্রচুর পরিমাণে ‘মাইন’ পুঁতে রেখে গেছে—কী সাংঘাতিক! আরো উদ্বেগজনক বিষয়, গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বহু সেতু।  স্যাটেলাইট ইমেজসহ বেশ কিছু ফুটেজে দেখা গেছে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানেই ধ্বংস করা হয় অন্তত সাতটি সেতু। দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীরে নোভা কাখোভকা শহরের খেরসন অঞ্চলের একটি বাঁধেও আঘাত হানা হয়েছে। বড় চিন্তার কারণ, এই বাঁধ ধ্বংস হলে পূর্ব তীরে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হবে। এই বন্যা ডেকে আনবে মারাত্মক বিপদ। কেননা, তীব্র বন্যার ফলে নদীতে পানির সংকট দেখা দেওয়ার কারণে জাপোরিঝিয়ায় অবস্থিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চুল্লি ঠান্ডা করার জন্য প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি পড়বে, যা ডেকে আনতে পারে বড় দুর্ঘটনা।

মনে রাখতে হবে, খেরসনে বিজয় এমনি এমনি আসেনি। ইউক্রেন এই বিজয়ের ভিত্তি গড়েছে একটু একটু করে। রাশিয়ান সরবরাহ লাইন, রেলওয়ে হাব এবং বিভিন্ন সেতু ক্রমাগতভাবে ধ্বংস ও অকেজো করে দেয় ইউক্রেনীয় বাহিনী। অবিরত আক্রমণের মাধ্যমে ক্রমশ কোণঠাসা করে তোলে রাশিয়ান বাহিনীকে। এভাবেই আসে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। এখন ইউক্রেনের উচিত হবে দোনেত্স্ক, লুহানস্কসহ যুদ্ধরত প্রতিটি এলাকায় একই কৌশল ব্যবহার করা।

খেরসনের ঘটনায় দেখা যায়, ইউক্রেনীয় বাহিনী কৌশলগত দিক থেকে বেশ তৎপর। যুদ্ধে জিততে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে যাচ্ছে। এবার লুহানস্ক ও দোনেেস্ক ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। যুদ্ধবাজ পুতিনের কাছ থেকে এই অঞ্চলের পুনরুদ্ধার বেশ কঠিন হবে যদিও, কিন্তু এখানে ইউক্রেনীয় বাহিনী সাফল্য পেলে দিন শেষে তা-ই হবে পুতিনের পরাজয়ের কফিনে শেষ পেরেক।

লেখকদ্বয় : সাংবাদিক
সিএনএন থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন

 

ইত্তেফাক/ইআ