সপ্তম মাস অতিক্রম করতে চলেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। দিন যতই গড়াচ্ছে, রাশিয়ান বাহিনীর জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া ততই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। ভুল প্রমাণিত হচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হিসাব-নিকাশ। তিনি যেসব কৌশল আঁটছেন, ভেস্তে যাচ্ছে সবই। চলমান যুদ্ধের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে পুতিনকে তুলনা করা যায় টাইটানিক জাহাজের ক্যাপটেনের সঙ্গে। দুর্যোগের আঁচ পেয়েও টাইটানিক যেমন এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে, ঠিক তেমনভাবেই বিপদ জেনেও সামনে ছুটে চলেছেন পুতিন। টাইটানিকের নাবিকের যেমন জাহাজের ‘অপরাজেয়তা’ সম্পর্কে গণনায় ভুল ছিল, ঠিক একই রকমভাবে ভুল প্রমাণিত হচ্ছে পুতিনের প্রতিটি অনুমান। সামনে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদের হাতছানি, তাতে কোনো পরোয়া নেই পুতিনের। বরং দিগ্ভ্রান্তভাবে এগিয়ে চলেছেন তিনি।
নিজের সক্ষমতার প্রতি অন্ধবিশ্বাসের কারণে টাইটানিক যেভাবে গভীর সমুদ্রে ডুবে যায়, একই পরিণতি লক্ষ করা যাচ্ছে পুতিনের বেলায়। ইউক্রেনের মাটিতে বোমা নিক্ষেপ করে পালটা আক্রমণে যেভাবে কুপোকাত হচ্ছে রাশিয়ান সৈন্যরা, তাতে করে বলা যায়, নিজের প্রকৃত ক্ষমতাকে ঠিকঠাক পরিমাপ করতে ব্যর্থ হয়েছেন পুতিন। ভুল মাথার পুতিন টাইটানিকের নাবিকের মতোই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন, জাহাজে ধাক্কা দেওয়া বরফখণ্ড হাতড়াচ্ছেন। পুতিনের কোনো কৌশলই কাজে দিচ্ছে না। বাস্তবিক অর্থে এই বিপর্যয় এড়ানোর কোনো কৌশল জানা নেই পুতিনের।
ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে কেউ আন্দাজ করতে পারছেন না যে, এই সংঘাতের শেষ কোথায়। উপরন্তু পুতিনের একের পর এক ভুল পদক্ষেপ যুদ্ধকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়, তা-ও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি পুতিন যে বক্তৃতা দিয়েছেন, বিশেষ করে সৈন্য বাড়ানোর ঘোষণা, আঞ্চলিক সংযুক্তিকরণের প্রস্তুতি হিসেবে গণভোট ও পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি, তা চিন্তার রেখা এঁকে দিচ্ছে ইউক্রেনসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের কপালে। পুতিনের গৃহীত নতুন নতুন কৌশল নিয়ে মহাচিন্তায় রয়েছে বিশ্ব। একগুঁয়ে-খেপাটে পুতিন যুদ্ধে জিততে আর কী কী কৌশল-পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, তা রহস্য বাড়াচ্ছে সবার মধ্যে।
এই সত্য মানতে হবে, বিশ্ব সম্প্রদায় যেহেতু পুতিনকে অস্ত্র ফেলে শান্তির পথে আহ্বান জানিয়ে আসছে, কাজেই শান্তির পথে হাঁটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে তার জন্য। এরকমটি ঘটলে বাস্তবিকভাবেই বেকায়দায় পড়বে কিয়েভ। আলোচনার টেবিলে বসলে সংঘাত বন্ধ হবে। বিভক্ত হয়ে পড়বে মস্কোর শত্রুরা। পুতিনের বাইরে যেতে পারবেন না অনেকেই। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এরকম কিছুই করেননি পুতিন। প্রতিহিংসাপরায়ণতার পথেই যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন তিনি। এর মাধ্যমে যে তিনি ভুল করে চলেছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, অনাগত ভবিষ্যৎ ঠিক কী হতে চলেছে, সে সম্পর্কে এখনো আন্দাজ করতে পারছেন না পুতিন। পারমাণবিক হুংকার ছুড়ে যে ভুল পুতিন করেছেন, তার বাস্তব অভিঘাত যে কতটা প্রকট হতে পারে, তা পুতিনের কল্পনারও বাইরে। পুতিন বুঝতেই পারছেন না পারমাণবিক পথে পা বাড়ালে সামনের দিনে কী ঘটবে তার ভাগ্যে! ঠিক টাইটানিক জাহাজ ধ্বংসের ঘটনার মতো কিছু ঘটলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
বেশ কিছু মর্মান্তিক ঘটনার পরও বিগত কয়েক দশক ধরে পুতিন রাশিয়াকে সেই সব সূত্রের সাহায্যেই পরিচালনা করেছেন, যা তার কেজিবি (রাশিয়ার গোয়েন্দা বাহিনী) থেকে শেখা :‘আপনার নিজের প্রয়োজনে মানুষকে সহযোগিতা করুন; ঘুষ দিন, কথা না শুনলে ভয় দেখান; যেভাবেই হোক চুপ থাকতে বাধ্য করুন; কথা না শুনলে তাদের নির্মূল করুন।’ বাস্তবিক অর্থেই এই সূত্র অনুসরণ করার ফলে পুতিনের সিংহাসনের পেছনে লাশের দীর্ঘ সারি জমা হয়েছে।
ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের যে গণনা, তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভুল। পুতিনের অপরিণামদর্শিতা হতবাক করছে রুশদের। ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিন বাহিনীর কৌশলগত ব্যর্থতাগুলো সত্যিকারভাবেই একেকটি মহাকাব্য। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যে ভুল পুতিন করেছেন, সম্ভবত তার হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি নিজেও। ইউক্রেনের মতো একটি ভঙ্গুর গণতন্ত্র, যা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও স্থানীয় দুর্নীতিতে জর্জরিত, তা নিয়ে এত আগ্রাসী হয়ে ওঠাটা পুতিনের জন্য কতটা জরুরি ছিল, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইউক্রেন আক্রমণ করে পুতিন বিপদে পড়লেও তা শাপে বর হয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লদিমির জেলেনস্কির জন্য। অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র, অভ্যন্তরীণ রেষারেষি কিংবা দুর্নীতিকে ছাপিয়ে এই যুদ্ধ সব ইউক্রেনীয়কে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। অভিন্ন জাতিসত্তায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ইউক্রেনীয়রা, যা স্মরণকালের রেকর্ড।
ন্যাটো জোট নিয়ে বহু নেতিবাচক কথা বলেছিলেন পুতিনের বন্ধু হিসেবে অভিহিত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের সময়ে ন্যাটো ঝিমিয়ে পড়েছিল। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সংস্থাটি, হয়েছে আগের চেয়ে শক্তিশালী। ন্যাটো এখন জোরেশোরে কথা বলছে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ পুতিনের বিরুদ্ধে—ইউক্রেন যুদ্ধ-সংঘাত সৃষ্টির জন্য পুতিনকে দোষারোপ করে আসছে শুরু থেকেই।
ইউক্রেন যুদ্ধের ঢেউ আছড়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে। ইউরোপ নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে জ্বালানির স্বল্পতায়। শক্তি-সক্ষমতা ভেঙে পড়ছে ইউরোপ জুড়ে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় জনগণের ব্যয় বাড়ছে বিপুল হারে, একই সঙ্গে ইউরোপে বাড়ছে জ্বালানি কিংবা অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যয়। যুদ্ধের তীব্র প্রভাব পড়েছে অন্যান্য রাষ্ট্রেও। যেমন—সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরাসরি প্রভাবিত হয়ে পড়েছে।
চরম অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে রাশিয়ার নিজের মাটিতেও। পুতিনের রাশিয়া পার করছে কঠিন সময়। মস্কোর একসময়ের ‘মহান’ সশস্ত্র বাহিনীর দুর্বলতা প্রকাশ্য হয়েছে, যা পুতিন কিংবা রাশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত বয়ে আনবে। যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে রুশ বাহিনী মুখ থুবড়ে পড়ছে, তাতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে পুতিনের দুর্বল নেতৃত্বও দৃষ্টিগোচর হয়েছে বিশ্বের। এবং মোটা দাগে একটি বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়াকে ঘিরে যে গালগল্প চলে আসছে যুগের পর যুগ, তা নিছক ‘ধাপ্পাবাজি’ ছাড়া কিছু নয়।
রক্তক্ষরণ হচ্ছে রাশিয়ার অর্থনীতিতেও। নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রাশিয়া মূলত আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গত মার্চে ১৯৩টির মধ্যে ১৪১টি দেশ জাতিসংঘের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বলেছে, ‘ইউক্রেনে পুতিনের আক্রমণ করা ঠিক হয়নি’। এরপর দিন যত গড়িয়েছে, ধারাবাহিকভাবে সবার সমর্থন হারিয়েছেন পুতিন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ ততটা ফলপ্রসূ হয়নি বলেই ধরে নেওয়া যায়। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও পুতিনকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘আজকের যুগ যুদ্ধের যুগ নয়’।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে পুতিনের গণনা ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের বর্তমান গতিবিধির প্রতি দৃষ্টি দিলেই এর উত্তর মিলবে। এর পাশাপাশি পুতিন যে হারে হুংকার ছাড়ছেন, তা সামনের দিনে আরো বড় বিপদের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। সম্প্রতি তিনি পারমাণবিক পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার ফলে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে। এমনকি যে ‘গণভোটের কৌশল’ ধরেছেন তিনি, তা-ও সমালোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে পুতিনের ভবিষ্যৎ কিংবা তার বিপজ্জনক শাসনব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী, তা নিশ্চিত করে বলাটা বেশ মুশকিল। এমনকি মরিয়া পুতিন এই পরিস্থিতিতে আরো কতটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবেন, তা-ও নিশ্চিত করে বলা শক্ত। এই অবস্থায় বলতেই হয়, পুতিনের রাজত্ব হয়তো শেষের দিকেই, ঠিক টাইটানিকের ক্যাপ্টেনের মতো! কারণ তিনি এমন অন্ধকার পথে হাঁটছেন যে আচ্ছন্ন অন্ধকার তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তিনি তা আন্দাজও করতে পারছেন না! খেই হারিয়ে ফেলা পুতিনের জাহাজ যেই গভীর জলে আটকা পড়েছে, সেখান থেকে উঠে আসাটা সহজ হবে না মোটেও।
লেখক : সাংবাদিক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর : সুমৃৎ খান সুজন