সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপনের স্বার্থে চাহিদাভেদে মানুষ বিলাসী পণ্যকে বাজারের ফর্দ থেকে বাদ দিতে পারলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যকে সহজে বাদ দিতে পারে না। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। এমনকি মহামন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সংকটকে বিশেষজ্ঞরা সত্তরের দশকের বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যার মূল কারণ ছিল তেলের সরবরাহ কমে যাওয়া। আর বর্তমানের অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হচ্ছে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশও মন্দ অর্থনীতির স্বীকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ১১ মাসে তেলজাতীয় পণ্যে আমদানিতে পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন। সেই হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ১০৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। নতুন সমন্বয়কৃত তেলের দামের কারণে পরিবহন ও বিদ্যুতের দাম বাড়ে। সর্বশেষ পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। পণ্য পরিবহন ও শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, কাঁচামাল, এমনকি শাক-সবজির দাম পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে মানুষ বিলাসী পণ্যের পাশাপাশি বাজারের তালিকা থেকে কম চাহিদার নিত্যপণ্য বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ কেউ এক বেলা, দুই বেলা খেয়ে থাকছে। নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা আরো শোচনীয়।
বাংলাদেশে বছরে ২০ লাখ টনের মতো ভোজ্য তেল লাগে। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদন হয় ২ থেকে ৩ লাখ টন। আর বাকি পুরোটাই, অর্থাৎ চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ হয় আমদানি থেকে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধি ৭ কোটি মানুষকে অনাহারের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঊর্ধ্বমূল্যের কারণ কি শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নাকি আরো কিছু? উত্তর হলো—যুদ্ধের পাশাপাশি রয়েছে অর্থ লুটপাট, দুর্নীতি, দায়িত্বশীলদের গাফিলতি, অনিয়ম, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, যা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ক্ষেত্রে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলেছে, বর্তমানে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে যে সংকট চলছে, তা ২০২৩ সালে খাবার না পাওয়ার সংকটে পরিণত হবে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলি এক সতর্কবার্তায় বলেছেন, বিশ্বের সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ অনাহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের যে ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, তারা ৮২টি দেশের নাগরিক। সম্প্রতি এক জরিপের তথ্যে জানা যায়, যুক্তরাজ্যের ২৫ শতাংশ মানুষ তাদের এক বেলার খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে যুদ্ধজনিত মূল্যস্ফীতির কারণে। অতএব বলা যায়, বিশ্ব আগামী বছরের মধ্যে খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, যদি না যুদ্ধের অবসান হয়।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দিয়েছেন এবং তা মোকাবিলায় দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে ফসল ফলানো ও মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় খাদ্য ও জ্বালানিসংকট মোকাবিলার মাধ্যমে অর্থনীতিকে ঠিক রাখতে চেষ্টা করছে সরকার।
যা হোক, অবস্থা দিনকে দিন যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে করে সম্ভাব্য খাদ্যসংকট বা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করতে সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে এবং অর্থ ব্যয় ও প্রকল্প গ্রহণে সাবধান হতে হবে। সম্প্রতি আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। এখন সরকারের কাজ হচ্ছে এই ঋণের সুপরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ এমনটি যাতে না ঘটে, তারই প্রত্যাশা করে সাধারণ জনগণ।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়