শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

ইঁদুরের কাছে মানুষের হার! 

আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:০৫

হাজার বছরের পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব বা আন্দোলন খুব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একটু বইপত্র ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে মানুষের বিপ্লব সংক্রান্ত সব তথ্য, তবে সেগুলোর প্রায়ই মানুষ জাতির অন্তর্বর্তী কলহ। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন যে ইঁদুরের বিরুদ্ধেও বিপ্লব সম্ভব? হ্যাঁ, এমনটাই হয়েছিল তৎকালীন ইন্দোচীন অর্থাৎ বর্তমানের কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম নামে যে দেশগুলি পরিচিত। 

ইন্দোচীন তখন ইউরোপের ফ্রান্সের ঔপনিবেশিকের অধীনে শাসিত হতো। ইন্দোচীনের রাজধানী হিসেবে তৎকালীন ফরাসী সরকার ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরকেই নির্বাচন করেন। ফরাসীদের পরিকল্পনা ছিল যে তারা হ্যানয়কে বানাবেন ফ্রান্সের আদলে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ১৮৯৭ সালে পল ডুমারকে ইন্দোচীনের গভর্নর জেনারেল হিসেবে যোগদান করানো হয়। পল ডুমার হ্যানয় শহরকে আধুনিক বানাতে শুরু করে ফরাসি পদ্ধতির অতি উন্নত স্থাপনা নির্মাণ। 

কিন্তু ইন্দোচীনের লোকদের আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা ছিল একদমই কম। মাটির নিচের বিশাল পাইপ দিয়ে বর্জ্য নিষ্কাশনের পদ্ধতি তাদের জানা ছিল না। তারা সব ময়লা নদীতে গিয়ে ফেলে আসতো। 

পল ডুমার এই জিনিসটা পরিবর্তন করার জন্য উঠে পরে লাগলেন তবে পল ডুমার যখন গভর্নর পদ ছেড়ে দেন তখন মাটির নিচে প্রায় সতেরো কিলোমিটার জায়গায় পাইপ লাগানো হয় এবং বলা হয় ভিয়েতনামে এটাই ছিল ভিয়েতনামের প্রথম ও পরিপূর্ণ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা।

এই মাটির নিচের পয়ঃনিষ্কাশন পদ্ধতিই প্রথম ইঁদুরের প্রবল উৎপত্তি হিসেবে বাধ সাধে। এর আগেও ফ্রান্স জুড়ে ইঁদুর একদমই ছিল না তা বললে ভুল হবে, তবে খুব অল্প। নিয়ম মেনে প্রতিকারও করা হতো তবে ইন্দোচীনের এই মাটি খুড়ে উন্নয়নের ফলে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যাবার ফলে ফরাসি ও ইন্দোচীনের জনগণ এর প্রতিকার খুঁজছিল।

ফরাসি ঔপনিবেশিক সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল এই সমস্যা সমাধানের জন্য। হঠাৎ ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পিছনে মূল কারণ ছিল ওই মাটির নিচের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। ওই পাইপগুলোয় প্রচুর ময়লা থাকায় ইঁদুরদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে এবং দ্রুত প্রজননের জন্য ইঁদুর বাড়তে থাকে বিপুল ভাবে, এমনকি একসময় এমন অবস্থা হয় যে ময়লার থেকে বেশি ইঁদুরের সংখ্যা দেখা যায়। 

আর এই পাইপগুলো সরাসরি সংযুক্ত ছিল ফরাসি কর্মকর্তাদের বাসায়। এদের বাসায় উন্নত বাথরুম ব্যবস্থা থাকলেও ওখান থেকেই চলে আসতো ইঁদুরগুলো। যা ওই কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের মনে এক ভয় সৃষ্টি করে দিয়েছিল। ইঁদুরের ভয় এতটাই বাজে হয়ে গিয়েছিল যে ঔপনিবেশিক সরকার কর্মকর্তারা ইস্তফা দিয়ে দেয়। 

ইঁদুরের জন্য প্রধান যেই সমস্যা শুরু হয় তা হলো খাদ্য সংকট ও মহামারী। এছাড়াও জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া শুরু করে। হ্যানয়ে ফরাসিদের একটি মেডিক্যাল কলেজে এও প্রমাণিত হয় যে মাটির নিচের পাইপগুলো থেকে আসা ইঁদুরগুলোই বুবানিক প্লেগের ভাইরাস প্রবেশ করছে এবং এগুলো বেশিরভাগই ভিয়েতনামি।

এত সমস্যার পর ফরাসি সরকার শক্ত হাতে ইঁদুর প্রতিরোধের জন্য পরিচ্ছন্নতা-কর্মীদের ইঁদুর মারার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইঁদুরের সংখ্যা এত বেশি থাকায় তারাও পেরে ওঠে না। এরপর নতুন পদ্ধতি হিসেবে ভিয়েতনামীদের বলা হয় একটি ইঁদুর মারতে পারলে এক সেন্ট করে দেয়া হবে। 

ভিয়েতনামীরা এই ঘোষণা শুনে তড়িঘড়ি করে ইঁদুর মারতে নামে। শর্ত ছিল মৃত ইঁদুরের লেজ কেটে পারিশ্রমিক সেন্ট কড়ায় গণ্ডায় নিয়ে নেবে জনগণেরা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে তারা ইঁদুর না মেরে শুধু জীবিত ইঁদুরদের লেজ কেটেই নিয়ে আসছে।

শেষরক্ষা আর হয়নি হ্যানয়বাসীদের তারা হেরে যায় ইঁদুরের মত এক ছোট প্রাণীর কাছে, অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় হ্যানয়বাসী। প্রকৃতির নিয়মে ইঁদুররা চলে না যাওয়া পর্যন্ত এই ক্ষতি অব্যাহত থাকে। ইতিহাসে পাতায় লেখা হয় এক অদ্ভুত যুদ্ধ, যেই যুদ্ধে হেরে যায় সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, জয়ী হয় বুদ্ধির হিসেবে অনেক নিচু এক জাতির। ইঁদুরের! 

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন