ব্যস্ত জীবনে মুক্তির স্বাদ পেতে প্রতি বছর হাজারো মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এলাকায় ছুটে যান। বিশেষ করে পর্যটন মৌসুমে হাজার হাজার মানুষের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অন্যতম দু’টি পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন। স্বচ্ছ নীল পানি আর সাগরের মধ্যে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পর্যটকদের আগ্রহের শীর্ষে থাকে সেন্টমার্টিন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতি বছর অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে ও অসচেতনভাবে পর্যটক ও স্থানীয়দের ফেলা বর্জ্যে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপের সৌন্দর্য। ভ্রমণে এসে ফেলে যাওয়া নানা রকমের ময়লা-আর্বজনাসহ প্লাস্টিক বর্জ্যে হুমকি তৈরি হয়েছে জীববৈচিত্রের ওপর। বিশেষ করে দ্বীপের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। যদিও প্রাকৃতিক নৈসর্গের এ দ্বীপ সংরক্ষণের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ চলমান রয়েছে। তবে সবার সচেতনতা ছাড়া এসব উদ্যোগের কোনোটাই ফলপ্রসু করা সম্ভব নয়। এ কারণে পর্যটক ও স্থানীয়রাসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সামুদ্রিক বর্জ্য পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে কোকাকোলার মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান। 'কেওক্রাডং বাংলাদেশ' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সমুদ্রসৈকতে কোস্টাল ক্লিনআপ কর্মসূচির আয়োজন করে চলেছে কোকাকোলা সিস্টেম বাংলাদেশ।
ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ ও কোকা-কোলার ২০৩০ সালের মধ্যে ‘বর্জ্যমুক্ত পৃথিবী’ অর্জনের লক্ষ্য পূরণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠান দু’টি গত ১২ বছর ধরে মিলিতভাবে বার্ষিক আন্তর্জাতিক কোস্টাল ক্লিনআপের আয়োজন করে আসছে। সম্প্রতি দ্বীপটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সামুদ্রিক বর্জ্য পরিষ্কারের এ কর্মসূচি পালন করা হয়। এ বছরের এই আয়োজনে ৪৫০ জনের অধিক স্বেচ্ছাসেবক এই ক্লিনআপ প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন সেন্টমার্টিনের স্থানীয়সহ সারা দেশের বিভিন্ন পেশার পেশাজীবী এবং বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ৩৬তম বার্ষিক আন্তর্জাতিক কোস্টাল ক্লিনআপের সাথে সমন্বয় করে এই আয়োজন করা হয়। সেন্টমার্টিনের সমুদ্রসৈকত থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা এ বছর ১৮০০ কেজির অধিক সামুদ্রিক বর্জ্য পরিষ্কার করেন। এই সামুদ্রিক বর্জ্যের বেশিরভাগই ছিল খাদ্যের প্ল্যাস্টিক মোড়ক, প্ল্যাস্টিক বোতল, বোতলের প্ল্যাস্টিক ঢাকনা, প্ল্যাস্টিক ব্যাগ ইত্যাদি ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দ্বীপে প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যাবহার হয়ে থাকে। কিন্তু পর্যটকদের ব্যবহার করা এসব প্লাস্টিকের যথাযথ ডাম্পিং করা হয় না। যা সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশকে ব্যাপকভাবে নষ্ট করছে। একইভাবে সাগরকেন্দ্রীক নির্ভরশীলদের জীবন-জীবিকাও হুমকিতে পড়েছে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে ৬৫ প্রজাতির প্রবাল ছিল, ২০১৬ সালে যা ৪১ প্রজাতিতে নেমে এসেছে। দ্বীপে বিভিন্ন ধরনের শৈবাল, শামুক-ঝিনুক এবং অগণিত প্রজাতির মাছ দেখা যায়। দ্বীপটি সবুজ সাগরের কচ্ছপ, জলপাই রঙের সামুদ্রিক কচ্ছপ এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রবালের জন্যও বিখ্যাত। পর্যটন মৌসুমে অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যক পর্যটকের আগমনের কারণে সরকার দ্বীপের সৌন্দর্য ও প্রকৃতি রক্ষায় বিধিনিষেধ আরোপ করে বিভিন্ন আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এরপরও দূষণের মাত্রা কমেনি। প্লাস্টিকসহ সামুদ্রিক বর্জ্যের পরিমাণ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, পানির বোতল, খড়, প্যাকেট, মাছ ধরার জালের টুকরো, নাইলনের দড়িসহ বিভিন্ন নন-বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দ্বীপে। এছাড়া পর্যটকের চাপ সামাল দিতে সাম্প্রতিক গড়ে উঠেছে শতাধিক ছোট-বড় হোটেল ও রেস্তোরাঁ। অপরিকল্পিত ও অনুমোদনহীন এসব রেস্তোরাঁর গৃহস্থালির বর্জ্য যোগ হয়ে সাগর দূষণ বাড়াচ্ছে। এ অবস্থায় কোস্টাল ক্লিনআপের মতো উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মো. মজিবর রাহমান বলেন, 'আমরা জানি, সেন্টমার্টিন দেশের অন্যতম বৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র। এর কারণে দ্বীপে প্রচুর বর্জ্য জমা হয়। এই সমস্যা হ্রাসের জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন, কিন্তু এর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। কোকা-কোলা ও কেওক্রাডং বাংলাদেশের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই।'
কোস্টাল ক্লিনআপের এ উদ্যোগ শুরু হয় ২০১১ সালে। এরপর থেকেই প্রতিবছরই এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিশেষ করে ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বেচ্ছাসেবকেদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামুদ্রিক বর্জ্য পরিষ্কারের এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এ সময় ঢাকা ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই স্বেচ্ছায় এ কার্যক্রমে অংশ নেন। স্থানীয় শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এ কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন।
কোকাকোলার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক কোস্টাল ক্লিনআপে অংশ নেন। এই সময়ে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজারের মতো সামুদ্রিক বর্জ্য পরিষ্কার করা হয়। পরিমাণে যা ১৩ হাজার কেজির বেশি। এসব বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে সিগারেটের বাট, খাবারের মোড়ক, স্ট্র, প্লাস্টিকের পানীয়ের বোতল এবং অন্যান্য প্লাস্টিক জাতীয় আবর্জনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, এ বছর কোস্টাল ক্লিনআপের কর্মসূচি পালন করা হয় মহান জাতীয় বিজয় দিবসে। এ কর্মসূচির আগের দিন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষার্থী ও দেশ-বিদেশ থাকে আসা স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে একটা পরিচিত সভার আয়োজন করা হয়। যেখানে কোস্টাল ক্লিনআপের এ কর্মসূচির বিষয়ে সবাইকে বিস্তারিত জানানো হয়। একইসাথে পরের দিন কীভাবে সবাই কর্মসূচিতে অংশ নেবেন সেটিও বুঝিয়ে দেয়। এই পরিচিতি সভা থেকে জানা যায়, এখানে আসা অনেক স্বেচ্ছাসেবকই একাধিকবার এ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। অনেকেই আছেন যারা টানা ১২ বছরই অংশ নিয়েছেন।
পরের দিন খুব সকাল থেকেই সেন্টমার্টিনের সাগরপাড়ে অন্যরকম এক দৃশ্যের মুখোমুখি হন পর্যটক ও স্থানীয়রা। একই রংয়ের টি শার্ট আর ক্যাপ মাথায় দিয়ে সাগরপাড় থেকে সামুদ্রিক বর্জ্য সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায় তাদের। ছোট ছোট গ্রুপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করতে থাকে পুরো দ্বীপে। তাদের হাতে পাটের বস্তা। কেউ সাগর পাড়ে, কেউবা আবার লোকালয় থেকে সামুদ্রিক বর্জ্য সংগ্রহ করছে। বস্তায় করে এসব বর্জ্য আনা হয় সাগরের উপরিভাগের নির্ধারিত জায়গায়। এখানেই এসব বর্জ্যকে আলাদা করা হচ্ছে। বর্জ্যের ধরণ হিসেবে সেগুলোকে আলাদা আলাদা বস্তায় রাখা হচ্ছে। একইসঙ্গে পরিমাণ হিসাব করেও করেও রাখা হয়। নির্ধারিত কর্মসূচি শেষে এসব বর্জ্য মাছ ধরার ট্রলারে করে পাঠানো কক্সবাজার ও টেকনাফে। সেখানকার সংশ্লিষ্টদের কাছে এগুলো হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে যার একটি অংশ রিসাইকেল ও একটি অংশ ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়।
এ কর্মসূচির বিষয়ে কোকা-কোলা বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তা জি তুং বলেন, 'প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং আমরাই এই সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী। আমাদের প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক দূষণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের নানা ধরনের উদ্যোগ আছে, তার মধ্যে এই কোস্টাল ক্লিনআপ অন্যতম। সেন্টমার্টিনকে প্লাস্টিকমুক্ত রাখতে কেওক্রাডং বাংলাদেশ ও স্বেচ্ছাসেবীরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এই দায়িত্ব আমাদের সবার। সেন্টমার্টিনে বেড়াতে আসা প্রত্যেকেরই এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে মানুষ আরও সচেতন হয়ে উঠবে এবং আমরা একটি বর্জ্যমুক্ত পৃথিবী অর্জন করতে পারবো বলে আমি আশাবাদী।'
সামুদ্রিক দূষণ রোধে কাজ করে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংগঠন ওশান কনজারভেন্সি। সংগঠনটির হয়ে বাংলাদেশে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে কেওক্রাডং বাংলাদেশ। এ কর্মসূচির বিষয়ে ওশান কনজারভেন্সির বাংলাদেশ অঞ্চলের সমন্বয়ক মুনতাসির মামুন বলেন, প্রতি বছর লাখো মানুষ সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বেড়াতে আসেন। কাজেই এই দ্বীপকে পরিষ্কার রাখা এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। কোকা-কোলার সহায়তায় আমরা গত ১২ বছর ধরে এই উদ্যোগ পরিচালনা করে আসছি। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের নিজের নিজের জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই দ্বীপকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমেই আমরা একটি পরিষ্কার ও বাসযোগ্য পৃথিবী অর্জন করতে পারবো।'