শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মেট্রোরেলের ভাড়া হোক সামর্থ্যবান্ধব

আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:০৮

‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’—গোবিন্দ হালদারের লেখনীতে ফুটে ওঠা কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার সূর্যের মতোই যানজটের শহরে পরম স্বস্তি এনে দিয়েছে মেট্রোরেল। উন্নয়নের অভিযাত্রায় পদ্মা সেতুর পর মেট্রোরেল চালু হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক। দেশের সার্বিক উন্নয়নে এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সর্বসাধারণের জন্য মেট্রোরেল প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনবে—এ কথা স্বীকার করতেই হয়। মানতে হবে, তীব্র যানজটের শহরে সময় বাঁচিয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রার ক্ষেত্রে মেট্রোরেল বিশেষ সহায়ক হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলকে বাংলাদেশের গর্ব ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নগর গণপরিবহন ব্যবস্থায় এটি অনন্য মাইলফলক।’ প্রধানমন্ত্রীর কথার সঙ্গে আমরা পুরোপুরি একমত।

তবে প্রশ্ন হলো, এই মেট্রোরেল দেশের সর্বসাধারণের জন্য সামর্থ্যবান্ধব কি না? প্রতি কিলোমিটারে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে ৫ টাকা। সর্বনিম্ন ও সর্ব্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে যথাক্রমে ২০ টাকা ও ১০০ টাকা। মেট্রোরেলের নির্ধারিত এই ভাড়া সিটি পরিবহনের (যেমন—গণপরিবহন তথা বাস) দ্বিগুণ। কোনো কোন ক্ষেত্রে প্রায় তিনগুণ—যা জনসাধারণের চোখে অযৌক্তিক বলে পরিগণিত হচ্ছে! এমন বাস্তবতায় যাত্রীদের সামর্থ্যের কথা বিবেচনা করে ভাড়া ৫০ শতাংশ কমানের দাবি জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মেট্রোরেলের ভাড়ার দিকে তাকালে আমাদের দেশে নির্ধারিত ভাড়ার ভারসাম্যহীনতার ব্যাপারটি আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। কলকাতায় মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ রুপি বা ৬ টাকা। সর্বোচ্চ ভাড়া ২৫ রুপি বা ৩১ টাকা। কলকাতায় ৫ রুপি বা ৬ টাকা দিয়ে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। ১০ রুপিতে ৫ কিলোমিটার, ১৫ রুপিতে ১০ কিলোমিটার, ২০ রুপিতে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। ২০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ রুপি বা ৩১ টাকা লাগে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে উত্তরা থেকে মতিঝিল ২০ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা, যা কলকাতার তুলনায় চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি। ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লির মেট্রোতে একই দূরত্বে ৪০ রুপি বা ৫০ টাকা লাগে। যা আমাদের নির্ধারিত ভাড়ার অর্ধেক। ছুটির দিনে এই ভাড়া নেমে আসে ৩০ রুপিতে। মজার ব্যাপার হলো, দিল্লির মেট্রোতে ৩২ কিলোমিটার পথ যাতায়াত করা যায় ৬০ রুপিতে। একই চিত্র পাকিস্তানের লাহোর অরেঞ্জ লাইন মেট্রোরেলে চলাচলের ক্ষেত্রে। এই মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া পাকিস্তানি ২০ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯ টাকা। ২৭ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য সর্বোচ্চ ৪০ রুপি বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮ টাকা লাগে। লাহোরের মেট্রোতে প্রথম ৪ কিলোমিটার ২০ রুপি বা ৯ টাকা। ৫ কিলোমিটার থেকে ৮ কিলোমিটারের জন্য ২৫ রুপি বা ১১ টাকা, ৯ থেকে ১২ কিলোমিটারের জন্য ৩০ রুপি বা ১৪ টাকা লাগে। ১৩ থেকে ১৬ কিলোমিটারের জন্য ৩৫ রুপি বা ১৬ টাকা লাগে। ১৬ থেকে ২৭ কিলোমিটারের জন্য ৪০ রুপি বা ১৮ টাকা লাগে। আগে লাহোর মেট্রোতে যে কোনো দূরত্বে যাতায়াতের জন্য ৪০ রুপি বা ১৮ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৮৮ ভাগ যাত্রীই পুরো ২৭ কিলোমিটারের বদলে প্রথম ১৬ কিলোমিটার অংশে যাতায়াত করেন। তখন মেট্রো কর্তৃপক্ষ যাত্রী সাধারণের সুবিধার্থে এভাবে প্ল্যানভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করেন। অর্থাৎ এখানে তারা সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন যাত্রীদের চাহিদা, সামর্থ্য ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়কে। অথচ দুঃখজনকভাবে এই চিত্র আমাদের দেশে বেশ ম্লান! যাত্রী কল্যাণ সমিতি কিংবা যাত্রীদের অধিকার রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত কোনো সমিতির সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা ছাড়াই অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করে কর্তৃপক্ষ। এমনকি শিক্ষার্থীদের জন্যও রাখা হয়নি হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা—বিষয়টি অবাক করেছে সকাইকে! এতে করে স্বপ্নের মেট্রোরেলে যাত্রা করা শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে—এই যুক্তিকে অবান্তর বলা যায় না আদৌ।

বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে কমপক্ষে ২৫-৩০ বছর সময় লাগে। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা না থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিনই তাদের ছুটতে হয় স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে; গুনতে হয় ভাড়া। আবার প্রতিদিনই হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শত শত শ্রম ঘণ্টা চলে যায় রাস্তার তীব্র যানজটের করাল গ্র্রাসে। এমন বাস্তবতায় মেট্রোরেলে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা না রাখা অত্যন্ত দুঃখজনক। এমতাবস্থায়, শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক অবস্থা, চাহিদা ও সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কর্তৃপক্ষের। এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অতি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই আমরা মনে করি। শুধু মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে নয়, জনগণের কল্যাণে নির্মিত প্রতিটি মেগা প্রকল্পই যেন জনবান্ধব হয়, জনগণের কাছে সহজলভ্য হয়, সে ব্যাপারটিকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের সুবিধা থেকে জনগণ যেন কোনোভাবেই বঞ্চিত না হয়—এই বিষয়কে ভালোভাবে আমলে নিতে হবে। জনগণ যেন দুর্ভোগ-দুর্বিপাকে না পড়ে, দরিদ্রতার কারণে প্রকল্পের সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে—এসব দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে গুরুত্ব সহকারে। মোটকথা, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সার্বিক দিক বিবেচনায় রাখতে হবে কর্তৃপক্ষকে। মেট্রোরেলের ভাড়া কমানো ও শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ায় যাত্রার সুযোগ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলেই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন