মানুষ শিক্ষিত হয় বা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চাকরির বাজারে ‘অপ্রতুলতা’ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কতশত শিক্ষিত বেকার যে ধরনা দিয়ে বেড়ান, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! যে সব চাকরির দ্বার খোলা আমাদের দেশে, তাতে চাকরি করার মতো পর্যাপ্ত দক্ষতাশক্তি নেই আমাদের—এ কথাও সত্য অনেকাংশে। ‘প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব’ চাকরির বাজারে বিশেষ ভোগান্তির নাম। এই যখন অবস্থা, তখন দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
শিক্ষা যে জ্ঞানের আলো ছড়ায়, তা দিয়ে মানুষ ও মানুষের মন আলোকিত হয়। এর ফলে মনের সব অন্ধকার দূরীভূত হয়। নতুন নতুন জ্ঞানের বিকাশ সাধন হয়। এই শিক্ষার সঙ্গে আরো কিছু দক্ষতার বিশেষ প্রয়োজন; বিশেষ করে বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে বের হয়ে ভালো কোনো কর্মসংস্থান না পেয়ে অনেকেই বেকার বসে আছেন—এমনটা দেখা যায় হরহামেশা। সুতরাং প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক—এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনা দিয়ে জীবনে ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না কেন? অর্থাৎ আমাদের পড়াশোনায় কোথায় ঘাটতি রয়েছে? এ কথা সত্য, অবশ্যই কোথাও না কোথাও ঘাটতি রয়েছে আমাদের শিক্ষায়। এ কারণে কীভাবে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব, সেদিকে বিশেষ নজর দিয়ে সবাইকে দক্ষতার উন্নয়নের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট—প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একটা বড় অংশই বেকার। এর আগে ২০২২ সালে ‘ভাতের বিনিময়ে পড়ানোর বিজ্ঞাপন’ দেওয়ার পর করোনা মহামারিতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কতটা সংকট তৈরি করতে পারে, তার একটা চিত্র সামনে আসে আমাদের। বেকারত্বের হতাশা আর চলমান নানা সংকট যে এখন কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, তা বোঝা যায় গণমাধ্যমগুলোতে উঠে আসা বিভিন্ন সংবাদের মধ্য দিয়ে। বাস্তবতা হলো, এক জন শিক্ষার্থীর ২৮ বছর শেষ হয়ে যায় পড়াশোনা শেষ করতে। সরকারি চাকরির শেষ বয়স তথা ৩০ বছরের মধ্যে বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরির জন্য আবেদনের তেমন একটা সময়ও থাকে না। এসবের মধ্যে তো বৈশ্বিক অস্থিরতার হাত ধরে দেশে দেশে নানা রকম অস্থিরতা ও জটিলতা তো আছেই। সব মিলিয়ে এক জন চাকরিপ্রার্থী প্রতিদিনের পথচলায় পড়েন বেশ মুশকিলে। এই অবস্থায় মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে সামনে আসে ‘দক্ষতার অভাব’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, একদিকে রয়েছে অশিক্ষা বা শিক্ষাবঞ্চিত তরুণ আর আরেক দিকে রয়েছে শিক্ষিত বেকার। একটি দেশ শিক্ষাব্যবস্থায় যত উন্নত, ততটাই উন্নত সে দেশের মানুষ। কিন্তু আমাদের দেশে রয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব। আবার যে সব কর্মসংস্থান রয়েছে সেগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষশক্তি নেই আমাদের। যথার্থ দক্ষতা অর্জনই তাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থায় পড়াশোনার পাশাপাশি সবাইকে নিজের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা বাড়ার কারণগুলো হলো—শিক্ষার সঙ্গে সমাজের মানুষের কাজের বা কর্মসংস্থানের সমন্বয়হীনতা, চাহিদামাফিক কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই, যেগুলোর সুযোগ রয়েছে সেগুলোর জন্য দক্ষ জনশক্তি নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী নয়, যেখানে প্রত্যেকেরই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে জীবনে একটা বড় ভালো জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা তাড়না কাজ করে। এসব কারণে পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে অনেকেই হতাশার সাগরে নিমজ্জমান। এর সঙ্গে রয়েছে আরেক বিপদ! বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন যতই ঘটছে, ততই বেকারত্বের হার বাড়ছে। কেননা নব নব প্রযুক্তির সঙ্গে ঠিক সময়ে নিজেকে দক্ষ করতে না পারায় অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছেন অনেকেই।
মনে রাখতে হবে, অদক্ষ যুবসমাজ বেকারত্বের হার বাড়ানোর জন্য বহুলাংশে দায়ী। কেননা বর্তমানে যুবসমাজের কর্মমুখী হওয়ার প্রয়াস খুবই কম। তারা শুধু ‘কোনোভাবে’ পরীক্ষায় পাশ করাকে চাকরি পাওয়ার মূল হাতিয়ার হিসেবে মনে করে থাকেন। নিজেকে কর্মক্ষম করার চেষ্টা খুব কম মানুষই করেন। যদিও বর্তমানে মানুষের ধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। ডিজিটাল জগতের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন অনেকেই।
এখন প্রশ্ন হলো, পড়াশোনা করেও চাকরি না পেলে পড়াশোনার মানটা কোথায় থাকল? কর্মক্ষম মানুষের কর্মের অভাবকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বেকারত্ব বলে। কর্মক্ষম মানুষ থাকা সত্ত্বেও দেশে কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে বরাবরই। আমরা যদি উন্নত দেশের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, জাপান, জার্মানি প্রভৃতি দেশগুলোতে রয়েছে জনসংখ্যার সঙ্গে কর্মসংস্থানের একটা সমন্বয়, যেখানে বেকারত্বের সমস্যা নেই বললেই চলে। এসব দেশে প্রত্যেকে প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। প্রত্যেকে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সবদিক থেকে দক্ষ করে তোলে বা গড়ে তোলার সুযোগ-সুবিধা অনেক। কর্মসংস্থানের অভাবও নেই এসব দেশে। চাকরিপ্রার্থীদের রয়েছে ব্যাপক দক্ষতাশক্তি। ফলে অর্থনীতি একটি ভারসাম্য গতির মাধ্যমে প্রবাহিত হয় এসব দেশে।
বাংলাদেশে এমন দক্ষতাশক্তি এবং সে দক্ষতাশক্তি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ দরকার। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে সবাই দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়ে সচেতন হন। এভাবেই কেবল বেকারত্বের অবসান ঘটতে পারে। সেই সঙ্গে জনসংখ্যার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সমন্বয় থাকা দরকার। কেননা আমরা দেখি জনসংখ্যার সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই দেশে। এমতাবস্থায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। ইংরেজি ভাষা শেখা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ, কম্পিউটারের বিভিন্ন কাজ শেখা, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। সর্বোপরি যেহেতু কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে দক্ষ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে দ্রুত তৎপর হওয়া অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব নিয়ে ভাবতে হবে সময় ফুরানোর আগেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়