বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কাঁদিয়েছিল প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু, তাই লিখলেন ‘ধুতরা জোছনার দিন’

আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:৪২

কথায় বলে, মানুষ তার উৎসের কাছে ফিরে ফিরে আসে। তেমনই একজন লেখকের গল্প বলবো আজ। নাম তার শাহাব আহমেদ। লিখেছেন উপন্যাস ‘ধুতরা জোছনার দিন’। কেন শেকড়ে ফিরে আসার কথা বলছি। পুরো লেখাটিতে তার উত্তর মিলবে। শাহাব আহমেদ এই উপন্যাসটি লেখা শুরু করেন ৪ বছর আগে। তার ভাষায় এই উপন্যাসের মূল চরিত্র আসলে ‘সময়’। এখানে ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সমাজ এবং এর সাধারণ জনগণ। 

ষাট, সত্তর ও আশির দশক। আমাদের দেশ যে পরিবর্তনগুলোর মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, সেই সময়গুলো ধরা হয়েছে এবং একইসঙ্গে এর আগে আমাদের সময়গুলো কেমন ছিল। সেখানে যে সম্প্রীতি, যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠা। নদীতে সাঁতর এবং গ্রামের হিন্দু মুসলমান সেখানে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। তারা কেউ আমাদের কাকা, জেঠা বা দাদা বলেই সম্বোধন করেছি। অনেক পুজো পার্বন, রোজা, ঈদ বা শবে বরাত একসঙ্গে কেটেছে। সেই সময়ে কীভাবে পার হয়েছে, বিশেষ করে একজন শিশু বা একজন কিশোরের চোখ দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন লেখক।  

নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা থেকে কী এমন ভাবনা এলো? শাহাব আহমেদ বললেন, তিনি দীর্ঘ ১৪ বছর ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরপর পাঁচ বছর কানাডায়। আর বর্তমানে বিশ বছর ধরে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
  
‘২০১৩ সালের দিকে আমি একবার দেশে এলাম। তখন আমার গ্রামে গেলাম। গিয়ে আমার গ্রামকে খুঁজে পেলাম না। আমার গ্রামটি ছিল পদ্মার তীরে। বিক্রমপুরের লৌহজং থানায় ঝাউটিয়া গ্রাম। সেই গ্রামটি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামটি হারিয়ে যাওয়ার কারণে তারা বাসিন্দারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। সুতরাং স্মৃতি ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই রইলো না। তখন মনে হলো-এই যে লোকগুলো যারা হারিয়ে গেছে, তাদের কীভাবে ধরে রাখা যায়। সেই চিন্তা করে উপন্যাসটি লেখা শুরু করি।
 
উপন্যাসের চরিত্র একজন বালক আসিফ। সেই ঘটনাটি বর্ণনা করছে। কীভাবে তার শৈশব কেটেছে। এরপর শুরু হলো যুদ্ধ। যুদ্ধে সে কী করেছে। গ্রাম থেকে ধাওয়া খেয়ে সে নারায়ণগঞ্জ চলে এসেছে। আবার নারায়ণগঞ্জে যখন বিমান হামলা শুরু হয়, আবারও সে সেখান থেকেও পালিয়ে গেছে। 

এই আসিফের মধ্যে আপনি কতোটুকু রয়েছেন? জানতে চাই শাহাব আহমেদের কাছে। তিনি বলেন, ‘এই আসিফের মধ্যে আমিও আছি। একজন লেখক কিন্তু তার গল্পে কোনো না কোনোভাবে উপস্থিত থাকেই। এই গল্পের আরেক চরিত্র আমি বলবো পদ্মা নদী। চার প্রজন্ম ধরে আসিফের পরিবারের বসবাস ছিল সেখানে। এক প্রজন্ম বাড়ি করে, সেই বাড়ি পদ্মা গিলে ফেলে। আবার তারা সরে এসে বাড়ি করে; আবারও গিলে ফেলে। পুরো ব্যাপারটা হলো পদ্মা তীরের মানুষ। তারা পদ্মাকে ছাড়তে পারে না। আবার পদ্মাও তাদের ছাড়ে না।’

উপন্যাস লেখার তাগাদা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একজন জেলের ছেলে যার সঙ্গে শৈশবে আমি খেলা করেছি। যখন জানতে পারলাম কোনো এক সময়ে পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ে মাছ ধরতে গিয়ে সে মারা যায়। বাস্তবে তার নাম ছিল গনেশ। কিন্তু উপন্যাসে অন্য নামে এসেছে। সেই মৃত্যু আমাকে এমনভাবে আপ্লুত করেছে! শুধুতো সে না। সেখানে আরও অনেক চরিত্র রয়েছে। এখন এই মানুষগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কেউ মারা গেছেন। কেউ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। ভারতে গেছেন কেউ কেউ। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। যাদেরকে চিনতাম, তারা কেউ নেই। উত্তর পুরুষের যারা আছে। তাদেরকে আমি চিনি না। তারাও আমাকে চেনেন না।’
 
শাহাব আহমেদ মূলত ভ্রমণবিষয়ক লেখালখি করে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। যখন সেভিয়েত ইউনিয়নে থেকেছি সেখানকার অভিজ্ঞতা থেকে দু’খণ্ডের একটি ভ্রমণ উপন্যাস লিখেছি। একটি হচ্ছে ‘লেলিনগ্রাদ থেকে ককেশাস’, অপরটি ‘ককেশিয়ার দিনরাত্রি’। এই উপন্যাসের চরিত্র লেলিনগ্রাদে থাকার সময় কী দেখেছে, কী করেছে এসব গল্প এবং সে উত্তর ককেশিয়া পর্বতমালা পর্যন্ত গিয়েছে। সেই ছেলে একটি রাশিয়ান মেয়ের প্রেমে পড়ে। এরপর প্রেমের ট্র্যাজিক পরিণতি সেটা নিয়ে এই ভ্রমণ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে জর্জিয়া ভ্রমণ কাহিনী। 

‘ধুতরা জোছনার দিন’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে বিদ্যাপ্রকাশ। দাম চারশত টাকা। এমন নাম প্রসঙ্গে লেখক শাহাব আহমেদ জানান, ‘ধুতরা সাদা, সুন্দর ফুল। দেখতে পবিত্র মনে হয় কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে বিষ। অন্যদিকে জোছনা যেহেতু আমাদের শৈশবে বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা গ্রামে থাকতাম। রাত হলে অন্ধকার। কিন্তু চাঁদনি রাতগুলো ছিল অন্যরকম। মনে হতো ফকফকে সাদা। এর সঙ্গে ধুতরা ফুলের তুলনা করেই এমন নাম।

ইত্তেফাক/এএএম