শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩, ১০ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন জরুরি

আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০২

বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্বকে ধারণ করা। ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ কথাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্ব। তাই বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে বিশ্বমানের। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্তবুদ্ধির জ্ঞান ও গণতন্ত্রচর্চার প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন পরিবেশ নেই বললেই চলে। দেশে দিনদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে না শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, শিক্ষার মান ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা। এই পর্যন্ত প্রস্তাবিতসহ প্রায় ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। আমাদের স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান। কিছু উল্লেখযোগ্য সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা হলো, পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব, শিক্ষকসংকট, শ্রেণিকক্ষের সংকট, ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাসনসংকট, পরিবহনসংকট, গবেষণার জন্য বরাদ্দ কম, শিক্ষার মানোন্নয়নে তহবিলের অভাব, শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তিগত সুযোগ সুবিধার অভাব, শিকক্ষ নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি, ছাত্র-শিক্ষক দলঅন্ধ রাজনীতি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে,  সরকার এসব সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়কে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগটির বিরোধী আমরা নই। কিন্তু একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে এজন্য আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। যাতে বাংলাদেশই বিশ্বমানের স্কলার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী তৈরি হয়। তখন কাউকে উচ্চশিক্ষার জন্য অন্যদেশে যেতে হবে না। বরং অন্য দেশের  শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের জন্য ছুটে আসতে বাধ্য হবে। তাছাড়া চীনের মতো যদি আমাদের দেশের সরকার কারিগরি শিক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করত, তাহলে অর্থনীতিতে দেশ আরো অগ্রগতি লাভ করতে পারত। চীন বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশ। তাদের এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে এই কারিগরি শিক্ষা। আশির দশকে চীনের সরকার দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। তারা মনে করেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া গ্রাজুয়েটদের কর্মসংস্থান করা আসলেই বড় কঠিন কাজ। তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চেয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রতি জোর দেয়। যার ফলে চীন কারিগরি ও প্রকৌশলী বিদ্যায় কতটা এগিয়েছে সেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি।

আমাদের দেশের সরকার যদি চীনের মতো এমন উদ্যোগ নেয়, তাহলে ২০৩০ বছরের মধ্যেই দেশের সার্বিক চিত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশও বিশ্বের সেরা ১০টি অর্থনীতির দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর বিশেষ করে শিক্ষার মান তলানিতে যাওয়ার কারণ হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি-বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু রাখা। এটা উচিত ছিল অল্পসংখ্যক নামকরা সরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু রাখা। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলাদেশের প্রায় ২ হাজার ২৭০টি কলেজে অনার্স কোর্স চালু আছে। যেখান থেকে বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী স্নাতক সম্পূর্ণ করে থাকে। আর কলেজ থেকে স্নাতক শেষ  করা ৬৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রী বেকার থাকে। তারা চাকরির বাজারে সুবিধা করতে পারে না। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া গ্রাজুয়েটদেরকে চাকরি দেওয়া কষ্টকর হচ্ছে, সেখানে কলেজ থেকে স্নাতক সম্পূর্ণ করা ছাত্রছাত্রীদের চাকরি দেওয়া কল্পনাতীত। তাই এসব অধিকাংশ কলেজে প্রথাগত শিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি বিষয়ক, কম্পিউটারবিষয়ক, ভাষাশিক্ষা ও প্রশিক্ষণবিষয়ক কোর্স চালু করা উচিত। পাশাপাশি যদি সর্বোচ্চ তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্স চালু রাখা যায়, তাহলে দেশে এত উচ্চ সনদদারি বেকার সৃষ্টি হবে না। আবার অনেক কলেজেই মাস্টার্স কোর্সও চালু আছে, যা সম্পূর্ণ যুক্তিহীন ও ভিত্তিহীন। মাস্টার্স কোর্স শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। আর বিশেষ করে বেসরকারি কলেজে তো একবারে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যদিও বর্তমানে সরকার বেসরকারি কলেজগুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা একটি ভালো, কার্যকরী ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এখন এই সিদ্ধান্ত  যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিত। 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের র‍্যাংকিংয়ে অনেক তলানিতে আছে। বিশ্বের সেরা প্রায় ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জার বিষয়। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং তলানিতে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের অভাব। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য দেশের প্রায় ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।  অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে চার গুণ বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ও গবেষণার জন্য টাকা বরাদ্দ বিশেষ ভূমিকা রাখে। ইউনেসকোর হিসাব অনুযায়ী, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা খাতে সেই পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় না। সর্বোচ্চ মোট জিডিপির ১.৮০ থেকে ২.২০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের শিক্ষা খাত কতটা উপেক্ষিত ও অবহেলিত। 

দেশের নীতিনির্ধারক ও সরকারের উচিত শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো। তাহলেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত শিক্ষা প্রদান করা সক্ষম হবে। আর এতে করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ আরো বেগবান ও সহজতর হবে। একই সঙ্গে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনের পরিবর্তে কর্মমুখী বাস্তব শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া আবশ্যক। এভাবে আমাদের দেশ একদিন বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন