‘প্রেম সর্বোৎকৃষ্ট মানবীয় অনুভূতি। এ কেবলই অনুভূতি, ক্রিয়া নয়। প্রেমের পরবর্তী ধাপ কাম। এ কেবল অনুভূতি নয়, ক্রিয়াও। এই ক্রিয়ার মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া। কিন্তু কামের রয়েছে শৃঙ্খলা। কাম যখন প্রেমবর্জিত ও শৃঙ্খলাচ্যূত হয়, তখন ঘটে এর বিকার।’
সুলেখক স্বকৃত নোমান তার এবারের প্রকাশিত গল্পের বই ‘কয়েকজন দেহ’ নিয়ে বলছিলেন এই কথাগুলো। তিনি বলেন, ‘এ বইয়ের অধিকাংশ গল্প নারী-পুরুষের দেহকেন্দ্রিক প্রেম, কাম ও বিকার নিয়ে রচিত। বাকি গল্পগুলো মানবেতর প্রাণিসহ নানা বিষয়ে।’
পাঠক সমাবেশ থেকে এই বইটি ছাড়াও ঔপন্যাসিক স্বকৃত নোমানের আরও উপন্যাসের যুগপূর্তি সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে। সেটির নাম ‘রাজনটী’। ‘কয়েকজন দেহ’ গল্পগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হলো-অনিলের হাসি, ঝিনুকের কান্না, সন্তান বধ, একদিন সাগরে, ফ্লাট নাম্বার ৭/৬। লেখক নিশ্চয় কোনো না কোনো উৎস থেকে খুঁজে পান তার গল্পগুলো। যদিও অনেক সময় সেটি পাঠকের কাছে খোলাসা করতে চান না।
জবাবে দুটি গল্প প্রসঙ্গে স্বকৃত নোমান বলেন, ‘ফ্লাট নাম্বার ৭/৬ ’ গল্পটি হচ্ছে ঢাকা শহরে ভাসমান যেসব যৌনকর্মীরা রয়েছে তাদের নিয়ে, যারা ফ্লাটে ফ্লাটে সার্ভিস দিয়ে বেড়ায়। এটি একটি মানবিক গল্প। ঢাকা শহরে এই যৌনকর্মীদের নিজের যতো সমস্যাই থাকুক না কেনো সার্ভিস দিয়ে যেতে হয়। কারণ এটাই তাদের রুটি রুজি। একজন সিনিয়রের কাছ থেকে বিষয়টি শোনার পরে এটিকে আমি গল্পে রূপ দেই।’
‘যেমন দ্বিতীয় গল্পটি হচ্ছে সন্তান বধ। এটি কয়েকটি মহিষকে নিয়ে গল্প। এগুলো হারিয়ে যায়। মালিক অনেক খোঁজাখুঁজি করে। কিন্তু পায় না। পরে একটা সময় অনেক ভাটিতে এগুলো পায়। কিন্তু কোনোভাবেই প্রকাশ করতে পারে না যে মহিষগুলো তার। সেগুলো নিলামে ওঠে। ওই মালিকই সেগুলো কেনেন ১২ লাখ টাকা দিয়ে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো মহিষগুলো ঠিকই তার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। অন্য কোথাও যায়নি। এটি রাজশাহী অঞ্চলের একটি বাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখা। বাস্তবতার সূত্র ছিল পরে নিজের মতো করে লিখেছি।’
স্বকৃত নোমানের ‘রাজনটী’ উপন্যাসটি প্রকাশ হয়েছিল ২০১১ সালে। উপন্যাসটি এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কারে ভূষিত হয়। গত ১২ বছরে উপন্যাসটির কয়েকটি মুদ্রণ ও সংস্করণ প্রকাশিত হয়। পাঠক-চাহিদা বিবেচনা এবার প্রকাশ হলো যুগপূর্তি সংস্করণ।
‘রাজনটী’ রচিত লোকপুরাণের এক বাইজিকে নিয়ে, যার নাম গুলনাহার। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষ দখল করে, এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কালে তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল তার মা। তার ঠাঁই হয়েছিল জাজিনগরের রাজধানী উদয়াচলের এক বাইজিকোঠায়। রূপ, যৌবন, নৃত্য ও গীতে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল তার খ্যাতি। তার জলসায় আসতেন মহারাজ, মন্ত্রীবর্গ, জমিদার ও বণিকরা। একদিন যুবরাজ কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়ে আত্মসম্মানটুকু নিয়ে উদয়াচল ত্যাগ করে সে পাড়ি দেয় অজানার উদ্দেশ্যে। তাকে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখান পণ্ডিত অজয় কুমার। তার সহযোগিতায় সে চলে আসে জন্মভূমি হরিদশ্ব গ্রামে। ততদিনে তার পৈতৃকবাড়ি হয়ে গেছে বেদখল। চিরতরে বাইজিবৃত্তি ছেড়ে সে শুরু করে নতুন জীবন। গ্রামের কেউ জানত না তার অতীতকথা। পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে সে নির্মাণ করেছিল একটি মসজিদ। কিন্তু একদিন প্রকাশ হয়ে পড়ল তার প্রকৃত পরিচয়। সমাজ দাঁড়িয়ে গেল তার বিরুদ্ধে, অস্বীকৃতি জানাল তার নির্মিত মসজিদে নামাজ পড়তে।
যুগপূর্তি সংস্করণ প্রসঙ্গে স্বকৃত নোমান বলেন, ‘প্রতি বছর বইমেলায় অনেক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। অধিকাংশ উপন্যাস মেলার পর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার উপন্যাসটি পাঠক বারো বছর ধরে পড়ছে, কয়েকটি মুদ্রণ ও সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রকাশিত হলো যুর্গপূর্তি সংস্করণ, এটা নিঃসন্দেহে আমার জন্য আনন্দের ঘটনা।’
বইটির প্রকাশক সাহিদুল ইসলাম বিজু বলেন, ‘ইতিহাস, লোকপুরাণ ও কল্পনার মিশেলে রচিত স্বকৃত নোমানের এই উপন্যাস এক যুগ ধরে পঠিত হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হতে থাকবে।’
স্বকৃত নোমানের বই দুটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল। একুশে বইমেলায় পাঠক সমাবেশের ৭ নম্বর প্যাভিলিয়নে বই দুটি পাওয়া যাচ্ছে।