শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

রাফিয়ার গল্প

আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৮:৩৭

'যে রাঁধে সে চুলও বাধতে জানে' বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যটি চট্টগ্রামের মেয়ে রাফিয়া বিনতে আলম এর জন্য যেন যথার্থই বটে। সম্প্রতি বিজনেস অলিম্পিয়াড এ তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন, সমকাল আয়োজিত জাতীয় বিজ্ঞান বিতর্ক উৎসব ২০২১-এর রানারআপ, সমকাল আয়োজিত বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ২০২২ এর সেকেন্ড রানারআপ। এছাড়াও যে বয়সে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে অভ্যস্ত থাকেন কিশোরীরা সে বয়সেই কিনা তিনি রন্ধনশিল্পে নিজেকে মেলে ধরলেন অনন্য ভাবে। মায়ের অনুপ্রেরণায় দশম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় ২০২০ সালে তিন হাজার প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে 'তীর লিটল শেফ সিজন-২'-এর সেরা রন্ধনশিল্পী হন রাফিয়া। এ বছর 'সেরা রাঁধুনি ১৪২৯' প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এই কিশোরী। এখন তিনি চট্টগ্রাম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। শুধু কি তাই! ছবি আঁকা, উপস্থাপনা, আবৃত্তিতেও নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার।

রাফিয়া জানান, ফেসবুকে CCPC Business Club এর পোস্ট দেখতে পাই। ভাবলাম যেহেতু বিজনেস সম্পর্কে কিছু ধারণা ও অভিজ্ঞতা আছে অংশগ্রহণ করে দেখি। যদিও সবেমাত্র এসএসসি শেষ করেছি। প্রথম সিলেকশন রাউন্ডটা মোটামুটি ভালোই হলো। অলিম্পিয়াডে মূলত বিজনেস ও কোম্পানি লিডিং, মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে হয়েছিল এবং অংশগ্রহণকারী কয়েক হাজার প্রতিযোগী থেকে মাত্র ২০জন ফাইনাল পর্বে যেতে পারবে। কিছুদিন পরেই কলেজ ভর্তি ও ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। হঠাৎ একদিন মেইল এবং কল আসে ফাইনাল পর্বের জন্য আমি সিলেক্টেড, তখন মনে হলো টপ ২০ এর মধ্যে যখন আসতে পারলাম ফাইনালটাও ভালোভাবে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এরপর ফাইনালে বলা হলো আগের ধাপের সঙ্গে যুক্ত হবে কেস সলভিং। বাট আমি কুল মাইন্ডে ফাইনাল পর্বটা শেষ করি। এরপর ফল প্রকাশ হলে দৌড়ে আম্মুকে জানাই। পুরস্কার গ্রহণের দিন নিজের নাম এনাউন্সমেন্টের সময় শুনে অন্যরকম একটা আনন্দ কাজ করছিল। অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা আর আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা আমার এই অর্জনের জন্য।

আমার চারপাশে এমন অনেক কিছুই আছে যা নিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব, বিশেষত যেটাতে আমার প্রতিভা আছে। ছোটবেলা থেকেই টিভিতে কার্টুনের চেয়ে রান্নাবিষয়ক আর বিজ্ঞানভিত্তিক প্রোগ্রামগুলো দেখতে বেশি পছন্দ করতাম। আর আম্মুকে চট্টগ্রামের হরেক রকম স্বাদ আর রেসিপির খাবার রান্না করতে দেখে আগ্রহ পেতাম। আমার রান্না করার কোনো প্রয়োজন না হলেও আমি আম্মুকে আবদার করতাম এরপর সময় পেলে রান্না করে পরিবারকে টেস্ট করাতাম, এভাবেই রান্নার শুরুটা হয়। আসলে নিজেও বুঝতে পারিনি কিভাবে রান্নাটা আমার প্রিয় জিনিস হয়ে উঠল!

তীর লিটল শেফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর পুরো বাংলাদেশ বিশেষত আমার চট্টগ্রামবাসীদের থেকে প্রচণ্ড ভালোবাসা, শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েছি। তারা বলছিল আমার হাতের রান্না তারাও খেতে চাই। এবং তখন কোভিডেরও প্রকোপ শুরু হলে সবাই ঘরবন্দী হয়ে যায়। সে সময়টায় পরিবারের অনুপ্রেরণা আর আমার আগ্রহে শুরু করি অনলাইন ফুড বিজনেজ "Rafia's Hungrylab". নামে। যা অল্প সময়ে আলহামদুলিল্লাহ বেশ সারা পায়। আর সেখান থেকেই বিজনেস, মার্কেটিং, সেলিং সম্পর্কে ভালোই অভিজ্ঞতা হয়ে যায়, যা আমাকে কাজে দেয় বিজনেজ অলিম্পিয়াডে। আর জাতীয় অর্জন হিসেবে এটার অনুভূতিও ছিল বর্ণনাতীত। তবে তীর লিটল শেফ আর বিজনেজ অলিম্পিয়াড দুটো ভিন্ন শাখা হলেও আমার ক্ষেত্রে দুটোর যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছে আমার আগ্রহ, চেষ্টা আর কাজের প্রতি ভালোবাসা।

আমি সবসময়ই চেষ্টা করি ব্যতিক্রমী কিছু করতে, সেই চিন্তা থেকেই চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো "Pinata breakable chocolate heartcake", customised letter doughnuts সহ আমার নিজস্ব বিভিন্নরকম আইটেম নিয়ে আসি যা বেশ সাড়া পায়। আর্থিকভাবে আলহামদুলিল্লাহ কল্পনার চেয়ে বেশি ইনকাম করেছি। Rafia's Hungrylab হতে আমার নিজের ইনকাম দিয়ে আম্মুকে পেনডেন্ট গিফট করি, যা আমার সবসময় স্বপ্ন ছিল।

সবকিছুর মূলে রয়েছে আগ্রহ। বিতর্ক, উপস্থাপনা, ছবি আঁকা, আবৃত্তিতে মায়ের অনুপ্রেরণায় পথচলা শুরু আর ক্রমশ আমার আগ্রহের জায়গায় পরিণত হয়। যখন অনুধাবন করি তখনই পড়াশোনার পাশাপাশি এগুলোকেও গুরুত্ব দিতে লাগলাম। তবে সময়ের সাথে সাথে পড়াশোনার চাপ ও বাড়ছে, তাই আমি প্রায়োরিটিওয়াজ ভাগ করে প্রতিটা জিনিসকে সময় দিই। এভাবেই ম্যানেজ করার চেষ্টা করি সবসময়।

আমার মা,বাবা আর আমার পরিবারই আমার এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। তাদের দেওয়া সাহস আর ভালোবাসায় আমি আজ এ অবস্থানে। আমার প্রতিটা ভালো কাজ আর অর্জনের পেছনে আছে আমার মায়ের অবদান আর অনুপ্রেরণা।

সামনে যেহেতু এইচএসসি তাই এখন পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছি। মহাকাশ নিয়ে গবেষণা, বিভিন্ন দেশের খাবার ও রন্ধনপ্রণালী এক্সপ্লোর করার ইচ্ছে আছে।

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন