বাংলা ভাষার বাইরে যেসব বিখ্যাত বই রয়েছে সেসব পড়ার সাধ পড়ুয়াদের সবসময় জাগে। কিন্তু ভাষার দুর্বলতার কারণে সেটা সবসময় হয়ে উঠে না। সে কাজটিই করে দেন অনুবাদকরা। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে ঘাটতি থাকলেও অনেকের অনুবাদ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এমনই একজন আনিসুজ জামান। তিনি গল্পকার, অনুবাদক ও সঙ্গীত শিল্পী। মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুরের সৈয়দ নগরে তার জন্ম। চাকরি সূত্রে প্রথমে জাপানে, পরে মেক্সিকোতে গেলেও সেখানে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন তিনি। বর্তমানে স্ত্রী সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন আনিসুজ জামান। তিনি স্প্যানিশ ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘শত বছরের নিঃসঙ্গতা’, আনহেলেস মাস্ত্রেত্তার ‘পরাণটাকে উপড়ে নাও’, হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির ‘কুয়ো’ এবং হুয়ান রুলফোর ‘পেদ্রো পারামো’, কলম্বিয়ার সমকালীন ছোটগল্পের সংকলন, ‘গাবোর দেশে গাবোর পরে’।
শুরুতে জানতে চাই বিখ্যাত উপন্যাস ‘পেদ্রো পারামো’র অনুবাদ প্রসঙ্গে
‘বাবার সন্ধানে কোমালা নামক এক মৃতদের গ্রামে এসেছে গল্পের নায়ক। কে জীবিত আর কে মৃত―এমন এক ধোঁয়াশার মধ্যে শুরু হয় হুয়ান রুলফোর ‘পেদ্রো পারামো’। অনেকে হয়তো এটিকে নোভেল বলবেন। কিন্তু ক্ষীণকায় এ উপন্যাসটি কাহিনী ও কাঠামোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ল্যাটিন সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপন্যাসের একটি হলো হুয়ান রুলফো’র ‘পেদ্রো পারামো’। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতো বিশ্ব বিখ্যাত লেখক তার লেখালেখির অনুপ্রেরণা হিসেবে রুলফো’র এই উপন্যাসের কথা বলেছেন। মার্কেজের মতে, স্প্যানিশ ভাষায় লিখিত সবচেয়ে সুন্দর উপন্যাস হচ্ছে ‘পেদ্রো পারামো’। আমি যদি এমন একটি উপন্যাস লিখতে পারতাম তাহলে আর কলম ধরতাম না।’
এবার আরও একটি অনুবাদ এসেছে সেটিও বিখ্যাত। এছাড়া আপনার অনুবাদ গল্পের বইও রয়েছে।
‘লাতিন কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি। উরুগুয়ের এই ঔপন্যাসিকের বিশ্ব নন্দিত উপন্যাস ‘এল পোসো’ (কুয়ো) প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৩৯ সালে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো যতোটা না বাস্তব তার চেয়ে বেশি অশরীরী। কাল্পনিক স্মৃতিতে বেঁচে থাকা কতোগুলো মানুষের গল্প এটি। এর প্রধান চরিত্র লিনাসেরো একজন ব্যর্থ মানুষ, বেঁচে থাকার অনাগ্রহ থেকে সে স্বপ্ন দেখে।
গল্পের অনুবাদ বই ‘গাবোর দেশে গাবোর পরে’। এই বইটি মার্কেজের পর যারা এসেছেন তাদের ওপর মার্কেজের কতোটা প্রভাব পড়েছে বা কতোটা পড়েনি সেই গল্পগুলো নিয়ে একটি গল্প সংকলনের অনুবাদ। এটা এসেছে অন্য প্রকাশ থেকে। এ বইয়ের প্রথম গল্পটি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের। বাকিগুলো হচ্ছে তাঁর উত্তরসূরি লেখকদের।’
অনুবাদের বাইরে নিজের কোনো গল্পের বই?
‘দ্বিতীয় গল্পের বইটা হচ্ছে ‘বেথুল’। এটাও অন্য প্রকাশ থেকে। এটা নিজের গল্পের বই। এখানে বিভিন্ন রকমের গল্প রয়েছে। আমি যদিও দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছি ১৯৮৫ সালের অনেক আগে। তারপরও আমরা যারা বাইরে থাকি প্রবাসীরা তারা কিন্তু দেশটাকে মাথায় করে ওখানে নিয়ে যান। যার ফলে অনেকে বলে শেকড় ছাড়া, আসলে কিন্তু শেকড় ছাড়া নয়। এর মধ্যে কিছু আছে বাংলার আবহে, কিছু আছে মেক্সিকান আবহে আর কিছু সাংকেতিক গল্প।’
মেক্সিকোতে আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যতোটা জানি সেখানকার একটি প্রেমের উপন্যাসও আপনি অনুবাদ করেছেন?
‘আনহেলেস মাস্ত্রেত্তার ‘পরাণটাকে উপড়ে নাও’। এটা মেক্সিকান একটি প্রেমের উপন্যাস। এই বইটি দিয়ে পুরো মেক্সিকোকে চিনতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে বলি ‘কুয়ো’ অনুবাদ বইটি দিয়েই আসলে আধুনিক লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের যাত্রা শুরু। হুয়ান কার্লোস ওনেত্তিকে আসলে অনেকে চিনেন না। আমিই প্রথম উনার বই অনুবাদ করে চিনিয়েছি। ‘পেদ্রো পারামো’ এবং ‘কুয়ো’ এসেছে পাঠক সমাবেশ থেকে। ‘পেদ্রো পারামো’ পুরোটা মুখস্থ বলতে পারতেন মার্কেস। এবং উনি বলতেন যখন আমার কলম থেমে যায় আমি তখন ‘পেদ্রো পারামোতে’ ফিরে আসি।’
আনিসুজ জামান বাংলা ভাষার দুটি ক্লাসিক ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও ‘হাজার বছর ধরে’ স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করছেন। এর মধ্যে হাজার বছর ধরে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছেন। অনুমতি পেলে এটা প্রিন্ট করা হবে।
অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ কেন?
‘এই প্রশ্নটা সবাই করেন। আর এটা করলেই চলে আসে রাজু আলাউদ্দিনের নাম। সে আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমি যখন একটু-আধটু লেখালেখি করতাম তখন সে আমাকে ‘তুই অনুবাদ করতে পারবি তোর লেখা ভালো’ এমন করে উৎসাহ দিতে থাকে। এই ‘করি করি’ করে একটা দুটো অনুবাদ করতে শুরু করলাম। এরপর সে আরও বড় কিছু করার উৎসাহ দেয়। এ পর্যন্ত ৯টি বই অনুবাদ হয়েছে। এছাড়া গল্পসহ নানা লেখালেখিতো রয়েছেই’।
কোন বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে বেশ আনন্দ লেগেছে?
‘প্রথমত আনন্দ পেয়েছি সব বই অনুবাদ করতে গিয়েই। আমি যখন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ অনুবাদ করলাম সেই ঘোর থেকে আমি বের হতে পারছিলাম না। ‘পেদ্রো পারামো’ যখন অনুবাদ করি তখন ওই জ্বর থেকে বেরিয়ে এই জ্বরে ঢুকে পড়েছি। এখন যেই গল্পই লিখতে যাই না কেনো পুরোটাই ‘পেদ্রো পারামো’র প্রভাব পড়ে যায়। এখন আর নিজের লেখাও লিখতে ইচ্ছে করছে না।’
অনুবাদ নিয়ে কতোটা তৃপ্ত?
নিজের অনুবাদ নিয়ে আমি সবসময় অতৃপ্তিতে থাকি। বারবার মনে হয় আরেকবার করলে আরও ভালো হবে। আবার এমনও হয়েছে ‘পেদ্রো পারামো’র যে এলাকা সেটা যেহেতু আমার কাছাকাছি তাই অনুবাদে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু অনেক অনুবাদ করতে গিয়ে আমাকে নানা এলাকায় ছুটে যেতে হয়েছিল। এটাতে কষ্ট থাকলেও তা আনন্দের।
প্রতিবছর বইমেলায় আসেন?
আগে এভাবে আসতাম না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আসতে হবে।