আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মানবজাতির জন্য বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য বাঙালি জাতির সর্বোচ্চ আত্মদান বাঙালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীন বাঙালি জাতির অভ্যুদয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে উত্থানের মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে একটি নবীন জাতি সমগ্র বিশ্ব মানবজাতির জন্য অসীম গৌরব ও অপরিসীম আনন্দের উৎস হয়ে উঠেছে।
আমেরিকা থেকে আফ্রিকা এবং ইউরোপ থেকে এশিয়া প্রতিটি দেশে, প্রতিটি রাজধানী ও শহরে আজ ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতির জয়গান গাওয়া হচ্ছে। বাঙালি জাতির ২১শে ফেব্রুয়ারির সুমহান গৌরবে সমগ্র বিশ্ব জাতিগোষ্ঠী আজ গৌরবান্বিত হয়ে উঠেছে। বিশ্বের প্রতিটি শহরে ও রাজধানীতে বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও বিজয়ের কথা শুনছেন শিশু-কিশোরেরা তাদের শিক্ষকদের ও মাতা-পিতাদের মুখে। ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারিস, জোহানেসবার্গ, মস্কো, বেইজিং, দিল্লিসহ বিশ্বের তাবৎ রাজধানী ও শহর এবং পল্লির স্কুল-কলেজে ব্ল্যাক বোর্ডে আজ ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রছাত্রীরা তাদের নরম হাতে চক ও খড়িমাটি দিয়ে বাংলাদেশের নাম লিখছেন।
জোহানেসবার্গের প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যখন তাদের শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইছেন বাংলাদেশ কোথায় এবং বাংলাদেশ কী জন্য বিখ্যাত? তখন শিক্ষয়িত্রী গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করে বলছেন যে, আমরা যে আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের দাবি করি এবং আমাদের ভাষার জন্য গর্ব করি, সে অধিকার ও গর্বের বিশ্ব স্বীকৃতি এনে দিয়েছে বাঙালি জাতি। এখান থেকে হাজার হাজার মাইল দূর এশিয়ার একটি ছোট্ট দেশ বাংলাদেশের মানুষ আজ থেকে ৬৭ বছর আগে সারা বিশ্ববাসীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির জন্য হাসিমুখে জীবন দিয়েছেন। সেই দেশের জাতির জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের মুক্তিদূত ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মতো এশিয়ার তিনি এক মহান নেতা।
আজ মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির হিরণ্ময় ঐতিহাসিক একদিন। আজ থেকে ৬৮ বছর আগে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে কুখ্যাত নূরুল আমিনের পুলিশ যখন ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মিছিলের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাচ্ছিল এবং সেই ঝাঁক ঝাঁক গুলির মুখে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং নাম না জানা অন্য শহিদ ভাইয়েরা ফুলের মতো ঝরে পড়ছিল, তখন কেউ কল্পনাও করেনি যে, সেই মহান শহিদদের রক্তমাখা পথ ধরে বাঙালি জাতি একদিন হিমালয়সম বিশ্ব গৌরব অর্জন করবে।
১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গে বন্দি ফ্রান্সের মহান দার্শনিক ও চিন্তাবিদ রুশো, ভল্টেয়ারদের মুক্তির জন্য ফ্রান্সের বীর জনগণ বাস্তিল দুর্গ দখল করে যে বিশ্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, তেমনি ১৯৫২ সালে বাঙালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিকনির্দেশক শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কারাগারে বন্দি অবস্থায় ভাষার দাবিতে অনশন শুরু করার সংবাদ অগ্নস্ফিুলিঙ্গের মতো সমগ্র ঢাকার, ঢাকার সব স্কুল-কলেজে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বীর ছাত্রছাত্রী ভাইবোনেরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বর্তমান জগন্নাথ হল সংলগ্ন অ্যাসেম্বলি হলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। শান্তিপূর্ণ সেই মিছিলে যে কেউ গুলি করতে পারে, এমনটা সেদিন কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু বাঙালি জাতির মধ্যে যে যুগে যুগে চরম বিশ্বাসঘাতক মির জাফর-মোশতাকরা জন্মগ্রহণ করে এবং বিদেশিদের সঙ্গে বাঙালি জাতির চরম সর্বনাশ করে, বাঙালি হয়েও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন সেদিন তা প্রমাণ করেছিল। পাকিস্তানি পাঞ্জাবি শাসককে প্রভু মেনে সেদিন এই কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা বাঙালি ভাইবোনের
মুখে বাংলার পরিবর্তে উর্দু তুলে দিতে চেয়েছিল। চিরায়ত বাংলার যে শ্যামল রূপসী রূপ তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কঠিন মরুভূমিতে পরিণত করতে চেয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বীর ছাত্রছাত্রীরা সেদিন তা মেনে নেয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না এবং সে ক্ষমতা ছিল পাকিস্তানি প্রভুদের এদেশি দালাল-প্রেতাত্মাদের হাতে। তাই কোনো উপায়ন্তর না দেখে জননী ও জন্মভূমিকে ভালোবেসে এবং মাতৃভাষাকে ভালোবেসে তাদের প্রিয় জীবন তারা ২১শে ফেব্রুয়ারির সকালে ঢাকার বুকে উত্সর্গ করে দিয়েছিল। তাদের সেই মহত্তম উত্সর্গের রক্তস্নাত পদচিহ্ন ধরে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহিদের দেশ হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাঙালি জাতির সেই রক্তস্নাত ২১শে ফেব্রুয়ারির পুণ্যলগ্নে বিশ্ব মানবজাতি অর্জন করেছে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের সাড়ে ৭ হাজার জাতিগোষ্ঠীর ভাষা যেখানে বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর চাপে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল, আজ তাদের বুকে ফিরে এসেছে আশা। মুখে ফিরে এসেছে ভাষা। চোখের তারায় তারায় ভেসে উঠেছে স্বপ্ন।
বিশ্ব মানবজাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে বাঙালি জাতির এই যে অনন্য অবদান, তার জন্য বিশ্বের সাড়ে ৭ হাজার ছোট-বড় জাতিগোষ্ঠী বাঙালি জাতির কথা আজ গর্ব ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বিশ্বব্যাপী উচ্চারণ করছে। এশিয়া মহাদেশের একটি ক্ষুদ্র দেশে আজ থেকে ৬৮ বছর আগে কীভাবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, কীভাবে মিছিল হয়েছিল, মিছিলে ছাত্রছাত্রীদের কী ধরনের পরিধেয় বস্ত্র ছিল, হাতে তাদের কী লেখা ব্যানার ছিল, তাদের মুখে কী কী স্লোগান ছিল, এসব বিবরণ সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাই মেল-এর মাধ্যমে তা আজ জানতে চাইছে এবং একজন আরেক জনকে তা জানাচ্ছে। ঢাকাস্থ ইউনেসকো অফিসের একজন কর্মকর্তা আমাকে জানালেন যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর থেকে ইউনেসকোর প্যারিস হেড কোয়ার্টারে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের শহিদদের ইতিহাস, বাঙালি জাতির ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস জানার জন্য তাদের হেড অফিসে এবং ঢাকা অফিসে বহির্বিশ্ব থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে বহু যোগাযোগ করা হচ্ছে।
বিশ্বের বহু বড় বড় জাতির তুলনায় বাঙালি জাতি একটি দরিদ্র জাতি এবং ক্ষুদ্র জাতি। বাংলাদেশের আয়তন ও মাত্র ৫৪ হাজার বর্গমাইল। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা মাত্র ৪৮ বছরের। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বের বড় বড় জাতিসমূহের কাছে এবং বিশ্বের বৃহত্তম দেশের কাছে বাঙালি জাতির গৌরব ও মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙালি জাতির কীর্তি গাথাকে বিশ্ব মানবজাতি তাদের নিজেদের কীর্তিগাথা হিসেবে বরণ করে নিচ্ছে। কারণ বিশ্ব মানবজাতির মধ্যে ছোট-বড় জাতিগোষ্ঠী মিলিয়ে সাড়ে ৭ হাজার মাতৃভাষা বিদ্যমান রয়েছে। এই সাড়ে ৭ হাজার মাতৃভাষা মানবজাতির সমৃদ্ধির ও স্বাতন্ত্র্যের মিলনমেলা। আকাশের গায়ে লক্ষ-কোটি নক্ষত্ররাজির মিলনমেলা যেমন আকাশকে নয়নাভিরাম করে তোলে, তেমনি মর্ত্যের বুকে সাড়ে ৭ হাজার মানব-মানবীর কলকাকলী মানবজাতিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে বিমোহিত করে তোলে। কারণ মানবজাতির অন্তরাত্মা তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষা তার ভালোবাসা। আর ভালোবাসা তার অমরত্বের কিরণধারা।
মাতৃভাষার প্রতি অপার ভালোবাসায়, মানবজাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি বাঙালি জাতি যে প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে পুণ্যময় যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, বিশ্বব্যাপী সমগ্র মানবজাতি হৃদয় দিয়ে আজ তা উপলব্ধি করছে যে, বিশ্বের মহামূল্যবান সব সম্পদের চেয়ে মাতৃভাষা অধিক মূল্যবান। মানব শিশু ভূমিষ্ঠলগ্নে যে ভাষায় মাকে ডাকে, যে ভাষায় মা তাকে ডাকে, সেই ভাষা বিশ্ব মানবজাতির এক স্বর্গীয় সম্পদ। বিশ্বের মহামূল্যবান কোনো সম্পদই মাতৃভাষার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। মাতৃভাষা অতুলনীয় এবং মাতৃভাষা স্বর্গীয়।
২০১৯ সালে বলা যায়, বাঙালি জাতি তার যৌবন অতিক্রম করছে। একটি জাতির জীবনে ৪৮ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যেই বিশ্ব মানবজাতির জন্য বাঙালি জাতি যে মৌলিক অবদান রেখেছে এবং মানবজাতির অধিকার ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে যে নব অধ্যায় সংযোজন করেছে, তা বিশ্ববাসী পরম বিস্ময়ে অবলোকন করছে ও অভিনন্দিত করছে।
বাঙালি জাতির বীরত্ব ও পরাক্রম, প্রতিভা ও সৃজনশীলতা, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বরণ করার জন্য বর্তমান সহস্রাব্দ অপেক্ষা করে আছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও পরাক্রম বিশ্ব মানবজাতি মুগ্ধ বিস্ময় অভিনন্দিত করবে, স্বাগত জানাবে। বাঙালি জাতির সেই শুভদিন দূরে নয়, যখন বিশ্ব মানবজাতির ঘরে ঘরে লেখা হবে যে, সূর্যের ন্যায় শক্তিশালী একটি জাতি যার নাম বাঙালি জাতি। লেখা রবে: বাঙালি জাতি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি। বাঙালি জাতির শৌর্যবীর্যের ইতিহাস বিশ্ব মানবজাতির প্রাতঃস্মরণীয় ইতিহাস। বিশ্ব মানবজাতির মাতৃভাষার ইতিহাস, বাঙালি জাতির ২১শে ফেব্রুয়ারির আত্মদানের ইতিহাস। পুণ্যময় ২১শে ফেব্রুয়ারি, মানবজাতির পুণ্যময় শুভদিন। যেদিনের পুণ্যে মানবজাতি ধন্য, যেদিনের পুণ্যে মাতৃঋণ পূর্ণ।
লেখক: সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার ও স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপনডেন্ট