সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

তানিয়া শারমিনের কাছে রান্না হলো এক মজার খেলা 

আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:৩৬

তানিয়া শারমিনের কাছে রান্না কেবল শিল্প নয় রীতিমতো গণিত ও বিজ্ঞান। কারও কাছে রান্নাটা আনন্দের, আবার কারও কাছে বিড়ম্বনার। তবে তার কাছে রান্না হলো এক মজার খেলা। আবিষ্কারের নেশা, সৃষ্টির নেশা। এক খাবারের সঙ্গে আরেক খাবার মেশালে নতুন খাবার তৈরি হয়। ফিউশন করা যায়। এ পর্যন্ত শত শত লোককে তিনি রান্নার ট্রেনিং দিয়েছেন। বইমেলায় আদি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রান্নার ‘পঞ্চস্বাদ’ বইটি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে-

কেন এ বইটি প্রয়োজন বলে মনে করেন?

‘রান্নার বইতো বিভিন্ন ধরনের হয়। কিন্তু আমি একটু ব্যতিক্রম কিছু করার চেষ্টা করেছি। এই বইয়ে রান্নার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন- ছোটদের খাবার, চটজলদি নাস্তা, দেশীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার, বিদেশি ঐতিহ্যবাহী খাবার আর হচ্ছে রোগীদের খাবার। ভিন্ন ভিন্ন রোগীর উপযোগী খাবার। পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বইয়ের একটি অ্যালবাম করা হয়েছে।’ 

এটা কী একটি বই নাকি আলাদা আলাদা বই?

‘রান্নার পঞ্চস্বাদ’ নামে একটি অ্যালবামের পাঁচটা বই। বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাই রয়েছে। এছাড়া সবাই যেন কিনতে পারে সেজন্য বইটি আবার পাঁচটি ভাগে বের হয়েছে। যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে খাবার তৈরির কথা বলেছি সেগুলো আবার আলাদা আলাদা করে বই আকারে করা হয়েছে।’

তার মানে বলা যায়, সবার উপকারে আসে এমন বই আপনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন?

‘অনেকবছর ধরে রান্না নিয়ে কাজ করছি। প্রায় বিশ বছর হয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় যেহেতু আমি শিক্ষকতা করেছি সেখানে শেখাতে গিয়ে আমার মনে হলো মানুষ কী চায়? বাস্তব জীবনে কোন রান্নাটা সবচেয়ে বেশি দরকার সেটা চিন্তা করে দেখলাম মায়েদের প্রধান সমস্যা হলো বাচ্চার জন্য কোন খাবারটা তৈরি করবে। কারণ, বাচ্চারা নতুন নতুন খাবার খেতে বায়না ধরে এবং তাদের খাবারটা পুষ্টিসম্মত হতে হবে। ওই বয়সে যদি পুষ্টির দিকটা লক্ষ্য না রাখি বড় হলে দেখা যাবে তারা বিভিন্ন রোগে ভুগে থাকে। এজন্য ছোটদের খাবারটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’ 

বাচ্চারা কী ধরনের খাবার খেতে চায় না?

‘বাচ্চারা আসলে একঘেয়েমি খাবার খেতে চায় না। তারা খাবারে ভিন্নতা চায়। সে চিন্তা করে বইয়ে বাচ্চাদের খাবারের কথা লিখতে গিয়ে বৈচিত্র্যময় খাবারের কথা। খাবার যেন দৃষ্টিনন্দন হয়। বাচ্চারা দেখলেই যেন খেতে চলে আসে। যেন তাদের খাবারের জন্য পীড়াপীড়ি করতে না হয়। নতুন কিছু খুজেঁ পায় খাবারে, খেলনার মতো কিছু পায়। আমি বাচ্চাদের খাবারে শসা বা গাজর দিয়ে গাড়ির মতো কিছু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ছবি দিয়েছি পাপেটের। এগুলো যে দিতেই হবে তা নয় তবে এসব দিলে বাচ্চাদের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। এতে খাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে শুধু খেলেই তো হবে না। সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও দৃষ্টিনন্দন হতে হবে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই ছোটদের নাস্তার বইটি তৈরি করেছি।’
 
বাকি পর্বগুলো কী নিয়ে? 

‘এছাড়া চটজলদি নাস্তা। সকালে ওঠেই সবার একটাই চিন্তা থাকে ব্রেকফাস্ট কী খাবো? কারণ এখন বেশিরভাগই ওয়াকিং। আমরা সবাই তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকি। মেয়েরাও কাজ করে। তাই এই অল্প সময়ের মধ্যে স্বামীর নাস্তা তৈরি করতে হয়, বাচ্চাকে নাস্তা দিতে হয়, নিজের খাবারটাও নিতে হয়। তখন হয়তো তেমন রসিয়ে-কষিয়ে রান্নার সময় থাকে না। এই চিন্তা করে বইয়ে প্রায় অর্ধশত ‘কুইক রেসিপি’ রেখেছি। যেটা খুব সহজে করতে পারবে। এখানেও পুষ্টির বিষয়টি আমি নিশ্চিত করেছি। কারণ সকালের নাস্তাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। লংটাইম ব্রেক দিয়ে আমরা যেটি খাই সেটিই ব্রেকফাস্ট। এটি যদি স্বাস্থ্যসম্মত না করি তাহলে সারাদিনের কাজে শক্তি পাব না। কারণ সকালের নাস্তাটাই সারাদিন আমাদের চাঙা রাখে।’ 

‘তৃতীয় হলো দেশীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার। আমরা কিন্তু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের দেশের মতো এতো খাবারের ঐতিহ্য খুব কম দেশেই আছে। এতো পিঠা, আচারের সম্ভার কোথাও নেই। তারপরও কিন্তু  বাঙালির রান্না সম্পর্কে বাইরের দেশের লোক খুব কম জানেন। তারা বাঙালি রান্না বলতে বুঝেন ভারতীয় বা পাকিস্তানি রান্না। আমরা নিজেরাও হয়তো জানি না। কিছু কিছু খাবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিছু আছে এক এলাকার খাবার আরেক এলাকার লোক জানে না। চেষ্টা করেছি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া খাবারগুলো এনে একটি ছকে রাখার।’
 
বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকার খাবার মানে তো শতশত খাবার। আপনি মূলত কোন এলাকাকে প্রাধান্য দিয়েছেন?

‘আমি সব এলাকাকে প্রাধান্য দিয়েছি। ঢাকা, চট্টগ্রামের কালাভুনা, মেজবানি, শুটকি। এমন করে সারাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া কিছু খাবার রেখেছি। যেহেতু বইটি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও করেছি সে কারণে দেশের বাইরের লোকজনও বুঝবে কোন কোন খাবারে আমরা সমৃদ্ধ। কারণ একটা দেশে যেতে চাইলে পর্যটকদের সে দেশের খাবারও কিন্তু আকৃষ্ট করে। মানে সেই দেশে গিয়ে কী খাবে?’

এরপর?

‘চতুর্থ আসে বিদেশি ঐতিহ্যবাহী খাবার। আমরা এখন কিছু না কিছু বিদেশি খাবার খেতে পছন্দ করি। চাইনিজ, থাই, মেক্সিকান, অ্যারাবিয়ান, ফিলিপিয়ান, মালয়শিয়ান সারাবিশ্বের জনপ্রিয় খাবারগুলো আমি চেষ্টা করেছি একসঙ্গে নিয়ে আসতে। প্রায় ৭০ দেশের রান্নার রেসিপি রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ দেশে আমার ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছে। তাই অনেক দেশের খাবারই আমার টেস্ট করা। যেহেতু আমার একটা প্যাশন রয়েছে তাই বাইরে গেলেই সেদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারটা খেতে চেষ্টা করি।’

আমাদের দেশে বিদেশি খাবার মূলত ধনীদের খাবার? তো অন্যরা বঞ্চিত হচ্ছে কী না?

‘এ ব্যাপারটি মাথায় রেখেই লিখেছি। আরেকটা বিষয় চেষ্টা করেছি সবাই যেন হাতের কাছেই জিনিসগুলো পান এবং কোথায় পাবেন সেটিও আমি উল্লেখ করেছি। কিছু কিছু রেসিপিতো থাকেই একটু কঠিন।’

‘আমার পঞ্চম পর্বটি রোগীর খাবার। বিভিন্ন রোগীর খাবার। ভিন্ন ভিন্ন রোগে যারা ভুগছেন তাদের খাবার মেইনটেইন করা খুবই জরুরি। আমাদের বিভিন্ন খাবার থেকে কিন্তু নানা রোগ হয়। কিছু কিছু রোগ আছে শুধু খাবার খেয়ে সারানো বা ঠিক রাখা সম্ভব। ডায়েট ও ডিসিপ্লেন মেইনটেইন করলে ওষুধ লাগবে না। আবার অনেক রোগ আছে যেটি ওষুধের পাশাপাশি চিকিৎসাও জরুরি। এসব বিষয় বিবেচনা রেখেই বইটি লেখা হয়েছে। অনেক গবেষণা করেই এটা করা হয়েছে। এজন্য পাঁচ পর্বের পুরো বইয়ে সাড়ে চারশ রেসিপি রয়েছে।’

ইত্তেফাক/এবি/কেকে