রোববার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৫ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বাবা-মায়ের সঙ্গে গল্পে গল্পে তৈরি হলো রয় অঞ্জনের ‘খেউরি ঘর’

আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:২২

প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধবী, শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবর, মোবাইল ফোন, পরকীয়া, স্কুল-কলেজ, পার্ক, বাদাম, রিকশা, ফুচকা, সিনেমাহল, ঘর, বারান্দা, রাস্তা, ফুটপাথ...এইসব এখন উপন্যাসের উপজীব্য আর বেস্ট সেলারের তালিকায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। রয় অঞ্জন এই ব্যতিক্রমের দলে। এবারের উপন্যাসটাও সেই ধারার বাইরে নয়। এবারের উপন্যাস নিয়েই তার সঙ্গে কথা হলো বইমেলার মাঠে।

বইটা যতোটুকু প্রাথমিকভাবে উল্টে-পাল্টে দেখেছি, বিষয়বস্তু একটু ভিন্ন মনে হয়েছে। আপনার কাছ থেকে জানতে চাই?

‘‘আমি যখন বইটা লিখছি তখন একটা ফোল্ডারের নাম দিতে হবে। তো আমি কী দেব? তখনই মনে আসছে ‘খেউরি ঘর’। সেই থেকেই এই নামটি। বলতে পারেন ২০২৩ এ এসে কেন এই নাম। কেন সেলুন বা পার্লার শব্দটা ব্যবহার করিনি। আমার চিন্তাটা অন্য ঘরনার। আমার চরিত্রগুলোও তেমন। গল্পের পটভূমি ১৯৪৭-বাংলা তখন প্রায় ভাঙনের কাছাকাছি। এই সময়টার কিছু আগে-পরের ঘটনা। গ্রামীণ বাংলার জীবনাচারের একটা খণ্ডিত চিত্র বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থে। তখনকার বাঙালি সমাজে মানুষের মধ্যে জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ নিয়ে বৈষম্যের বিনাশী চিত্র ছিল চিরায়ত। আবার উল্টো চিত্রও ছিল সমানভাবে। সৌন্দর্যে, সৌকর্যে আর সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ। এই চির সুন্দর মানবিক দৃশ্যপটটাই অক্ষর দিয়ে আঁকার চেষ্টা করেছি কেবল। ধর্মে ধর্মে বিভেদের রেখা ভালোবাসা আর সম্প্রীতির মাধ্যমে মুছে ফেলা সম্ভব হলেও সেসময়ে বর্ণ বৈষম্যতার পাঁচিল টপকানো ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেই কাজটাই মমতা আর মহানুভবতার জলে মুছে ফেলার গল্পের নায়ক-বনমালী।’’

‘‘বনমালী একজন নিম্নবর্গীয় তথা পিছিয়ে পড়া জনজাতির ঘরের মানুষ, পর্যায়ক্রমে ছেলে- যুবক-পিতা। অন্য অর্থে দলিত শ্রেণীর। গল্পের পতিত জমিদার শশীবাবু, বারেক চেয়ারম্যান, মতিস্যার, দুবাই ফেরত কাদের গংরা আবির্ভূত হয়েছেন সেই সমাজের ঘুণ সারানো প্রতিষেধক হিসেবে। তেমনি এক উত্থান-পতনের গল্প এই ‘খেউরি ঘর’।’’

যেটা বলতে চাইলেন গল্পের পেছনের গল্প?

‘আমার বাবা অনেকদিন বিছানায় ছিলেন। শেষের দিকটায় ছয়-সাত মাস উনি রাইসটিউবে খেতেন এবং বাবার নার্সিংটা মূলত আমিই করতাম। ডাক্তার বলছিলেন উনাকে খাওয়ানোর পর অন্তত ২০ মিনিট হুইলচেয়ারে বসিয়ে রাখার জন্য। শেষের দিকে উনি এই বিশ মিনিটও নিতে পারতেন না। বিছানায় শোয়ার জন্য অস্থির হয়ে যেতেন। আমি কি করতাম, বাবাকে কোনো না কোনো গল্প করা শুরু করতাম। গল্প তুলে দিলে বাবা এতো সুন্দর করে গল্প বলতেন যেন চোখের সামনে ভাসছে। তখন বাবা এই গল্পগুলো আমাকে বলতেন। আমাদের গ্রামটা হচ্ছে বায়োয়ারী গ্রাম। সেটি সব ধর্মের। তো একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, যারা আমাদের চুল কাটেন তাদের কেন পয়সা দেই না? এক নাপিত কেন চুল কাটেন? তখন মা বললেন, যজমানি বলে একটা প্রথা রয়েছে। সেই থেকে মাথায় আসে এই বিষয়টি নিয়ে লিখবো। সেই থেকে লেখাটা শুরু। সবচেয়ে বড় দানাটা বাঁধছে আমার কলকাতা গিয়ে। সেখানে কবি সাহিত্যিকের একটা বন্ধুচক্র রয়েছে, যেখানে বসে আমরা আড্ডা দেই রবীন্দ্রসদনে। সেখানে কবি অরূপ পান্তি নামে এক বন্ধু রয়েছে। উনাকে বললাম, দাদা আমি এবার এই নিয়ে লিখছি। উনি বেশ অবাক হলেন দলিত সম্প্রদায় নিয়ে লিখছি বলে। তিনি তথ্য দিলেন পশ্চিমবঙ্গের একজন এমন দলিত সম্প্রদায় নিয়ে লিখেছিলেন যেটা বেশ আলোড়ন তুলেছিল এবং পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তখন আমি আরো উৎসাহ পেলাম এবং আরো তাগিদ দিয়ে লেখা শুরু করলাম।’

তাহলে বেশ দীর্ঘ সময় নিয়ে লিখেছেন এটি?

‘দিন হিসেব করলে মোটামুটি আড়াই বছর লেগেছে এটি লিখতে। কারণ শেষের দিকে এসে এমন হয়েছে, প্রথম দিকে আমি যা লিখেছি তা ফেলে দিয়েছি। লেখালেখির বিষয়ে আমি বেশ নিষ্ঠুর ও খুঁতখুঁতে। লিখতে গিয়ে আমি চিন্তা করি আমার তথ্যগুলো ঠিক আছে কিনা এবং পাঠকের কাছে স্মুথ রিডিং কি না?’

আগের বইগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে যদি বলতেন?

‘‘আমি মূলত রবীন্দ্র আশ্রয়ী একজন মানুষ। বলি না রবীন্দ্রভক্ত। এ পর্যন্ত সাতবার শান্তিনিকেতন গেছি। শেষের চার-পাঁচবার আমি একা একা গেছি। রবীন্দ্রভারতী, বিশ্বভারতী এগুলা আমি চষে বেড়াতাম একা একা। সবাই আমরা ঘুরি কিন্তু আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার একটা অভ্যাস আমার আছে। সেই থেকে প্রথম লেখা ‘রবি বাউলের শান্তিনিকেতন’, ওটাতে আমি লিখেছি রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনটা। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের যে একটা বাউল সত্তা রয়েছে সেটি। এর পরের বছর আমি চিন্তা করলাম, আমি ঘোরাঘুরি করার মানুষ। তো ‘পথিক পরান’ নামে আরেকটি ভ্রমণকাহিনী লিখেছি। নামটা দেখলেই বোঝা যায় আলভোলা পথিকের গল্প। আমি ওপার বাংলার বকখালী দ্বীপ ও পুরুলিয়া পাহাড় (অযোধ্যা পাহাড়) আর এপার বাংলায় যেটা করলাম- বান্দরবান (একা একা এগারো দিন ছিলাম) আর আমার গ্রাম, সেটি একটি গণ্ডগ্রাম, কুমিল্লার মুরাদনগরের কামাল্লা গ্রাম।’’

একজন পাঠক কেন আপনার বইটি পড়বেন বলে মনে করেন?

‘এখন পরিবর্তনের যুগ। কালকে যেটা নতুন ছিল আজকে সেটা পুরাতন হয়ে গেছে। আমাদের যে দলিত সম্প্রদায় তারা সকাল-বিকাল সেবা দিয়ে যাচ্ছেন- সেবা বলছি এই কারণে, তাদের যে সন্মানি দেয়া হয় সেটা পরিশ্রমের কাছে কিছুই নয়। অথচ তাদেরকে আমরা হেয় করি, ফেলে দেই, গুরুত্ব দেই না। তাদের কখনো আমরা সামনে এনে বসাইনি। মেথর, নাপিতদের আমরা কখনো সামনের দিকে আনি না। আমার ইচ্ছে ছিল তাদের সামনে তুলে আনা। আরেকটা বিষয় ছিল আমার গল্পের, যে প্রধান চরিত্র বনমালী, উনাকে আমি কোথায় নিয়ে ছেড়ে দেব। এই চিন্তায় আমি তিনমাস লিখতে পারিনি। পরে উনার পেশাকে আমি উন্মুক্ত করে দিলাম। এখন শুধু নাপিতরা না, অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষও চুল কাটছে। সে কারণে শেষের দিকে বনমালী তার ঘরটা হস্তান্তর করতে পারে।’

লেখালেখি নিয়ে আপনার সন্তুষ্টি কতোটুকু?

‘লেখালেখি নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্টি কখনো আসে না। তবে আমি চেষ্টা করেছি নানাবিধ তথ্য এখানে দিতে। এমনিতে আমাদের পাঠাভ্যাস কমে গেছে। মানুষ ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত। তো আমি চেষ্টা করেছি পাঠককে বইয়ের মধ্যে ঢোকাতে। সে হিসেবে কেউ যদি বইটি পড়ে বলেন ভালো হয়ে, সেটিই তৃপ্তি। আবার যখন কেউ বলেন লেখাটি খোলসা হয়নি, তাতেও আমি কষ্ট পাই না। পরবর্তীতে এটা ঠিক করার একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করি।’

ইত্তেফাক/এসকে