শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কবিতার সঙ্গে বসবাস সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের

আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:১৯

‘তৃষ্ণার্ত তরুণী সঙ্গমানন্দে
কাঁদছে।
কাঁপছে তির তির, তির তির
জল পড়ে, পাতা নড়ে!’

কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। মূলত কবি হলেও শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করছেন। তার কবিতায় গ্রাম-বাংলা থেকে শুরু করে নগরায়ন, নাগরিক জীবন, জীবনের জটিলতা, প্রেম, পরবাস, পরাবাস্তব প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রতিনিয়ত তিনি কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। শুধু তার একটি কাব্যগ্রন্থ থেকে আরেকটি কাব্যগ্রন্থ আলাদা নয়, একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতাও ভাষা-বিষয়-উপস্থাপনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবার অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে বেহুলা বাংলা প্রকাশ করেছে ‘সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। এসব বিষয় নিয়ে চ্যাটবক্সে কথা হয় কবির সঙ্গে।

প্রশ্নটা আচমকাই, যদি বলি কবিতা কেন লেখেন?

‘কবিতা লিখি শেষ ৭০ থেকে। কবিতা লিখি এই কারণে, কবিতার সঙ্গে বসবাস বলা যায় আমার। আমি কবিতার মধ্যে মিশে আছি, কবিতা আমার মধ্যে মিশে আছে। এই মিশে থাকাটাই নিজেকে বহিপ্রকাশ করা। আমার একটি সামাজিক দায়িত্ব যখন আমি পালন করতে পারি না, এই কাজগুলো আমি কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদ করি, ভালোবাসা প্রকাশ করি, মানুষের মঙ্গল কামনা করি। অর্থাৎ আমার ভেতরে যে আরেকটা ‘আমি’ আছে, সেটা আমি প্রকাশ করি নান্দনিকভাবে, ইতিবাচকভাবে, যা মানুষের কল্যাণে আসে। শুধুমাত্র মানুষ নয়, বৃক্ষের জন্য, পরিবেশের জন্য, প্রকৃতির জন্য আমার অনেক কিছুই বলার আছে। সেগুলো বলি বা সেবা দান করি।’

সাহিত্যের অনেক মাধ্যমে আপনার বিচরণ, কিন্তু কবিতা আপনার প্রিয় মাধ্যম বলে জানি?

‘শিশু সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, গবেষণা, রাজনৈতিক লেখা, মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আমার পদচারণা ছিল, আছে ও থাকবে। কিন্তু তারপরও আমার প্রকৃত পরিচয় থাকবে কবিতায়, কবিতায় এবং কবিতায়। কবিতা লিখে অনেক সম্মান পেয়েছি। প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। তাদের আপনজন হয়েছি। অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি। এটা অত্যন্ত গর্বের আমার জন্য। আমি এক সাধারণ স্কুল মাস্টারের ছেলে। কবিতা লেখার কারণে বাংলা সাহিত্যের, সংস্কৃতির লোক হিসেবে মানুষ আমার নামটি জানে, চেনে। এটাকে অর্জন করতে মানুষের ভালোবাসার জন্য যা কিছু দরকার করেছি। আর বেদনার বিষয় হলো দেশের জন্য এতোকিছু করার পরও আমাকে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে, দেশান্তরী হতে হয়েছে। যদিও আমি বাংলাদেশের ভেতরে থাকি, বাংলাদেশ আমার ভেতরে থাকে।’

বর্তমান বাংলা কবিতার মূলধারাকে শাণিত করছেন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। বাঁক ও বিবর্তনে ভূমিকা রাখছেন। তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদান রাখার জন্য দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছেন। এবার প্রকাশিত হয়েছে তার শ্রেষ্ঠ কবিতার বই।

শ্রেষ্ঠ কবিতা কতোটুকু শ্রেষ্ঠ?

‘যে অর্থে শ্রেষ্ঠ কবিতা বিবেচনা করা হয়, সে বিচারে গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো তা নয়। তবে অবশ্যই সেরা কবিতা। কারণ, প্রতিটি কবিতাই নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রচিত। সেইসঙ্গে বিষয়বৈচিত্র্যেও স্বতন্ত্র। গ্রন্থে দুই মাসের (সেপ্টেম্বর ২০২২, নভেম্বর ২০২২) লেখা কবিতাগুলোর সাথে ফর্মা পূরণের জন্য ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের চারটি কবিতা আছে। যার মাধ্যমে কবিতার একটা বহুমাত্রিকটা প্রকাশ পায়।’

ইদানিং প্রায়ই শোনা যায় কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে?

‘এমনি পাঠাভ্যাস কমে যাচ্ছে এটা ঠিক। আগে মানুষ পড়াশোনার প্রতি যতটা আকৃষ্ট ছিল, এখন অনলাইন বা প্রযুক্তির কারণে অনেকেই বইবিমুখ হয়ে পড়েছে। অনলাইনভিত্তিক বা প্রযুক্তিভিত্তিক যারা পড়ছেন তাদের আমি ঠিক পাঠক মনে করি না। পাঠক হওয়ার জন্য যে মেধা দরকার, যে যোগ্যতা দরকার, যে উচ্চতা দরকার তাদের মধ্যে সেটা নেই। আমি মনে করি, একজন লেখকের চেয়ে একজন পাঠক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাজে লেখক হওয়ার চেয়ে ভালো পাঠক হওয়া প্রয়োজন। তবে এ কথা সত্য, অনেক পাঠক আছেন যারা নীরবে-নিভৃতে কবিতা পড়েন, কবিতাকে লালন করেন, কবিতাকে মর্যাদা দেন। সেই সংখ্যা কম হলেও একাই একশো।’

দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে আছেন, দেশের কথা যখন মনে পড়ে কী করেন?

‘প্রবাসে থাকলেও আমি নিজেকে প্রবাসী মনে করি না। আমি আগেও লিখেছি কুমিল্লায় থাকা আর কানাডায় থাকা একই কথা। এটা একটা অবস্থানগত দূরত্ব মাত্র। কারণ প্রতি মুহূর্তে আমি বাংলাদেশের সঙ্গে আছি, বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে আছি, বাংলা ভাষার সঙ্গে আছি, সংস্কৃতির সঙ্গে আছি। আমার জীবন-যাপন সম্পৃক্ততা সবকিছু বাংলার সঙ্গে। সে কারণে আমি কোনোভাবেই প্রবাসী মনে করি না। কাকতালীয়ভাবে হয়তো এখানে থাকতে হয়েছে। বাংলাদেশকে মিস করি ঠিকই, কিন্তু আমার মুঠো মুঠো চাল কবিতার মতো আমিও মুঠো মুঠো ছুটি জমিয়ে মায়ের কাছে যাই, আমি দেশের কাছে যাই। লক্ষ্য করলে দেখবেন আমার কবিতায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল যেমন ধরা দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মিথ, সংস্কৃতি রয়েছে। বাংলাদেশকে আমি আমার চিন্তা-চেতনা-ভাবনায় সমৃদ্ধ করতে চাচ্ছি। তবে এটা ঠিক বইমেলা মিস করি, বিভিন্ন অনুষ্ঠান মিস করি, শাহবাগে একটা রাজত্ব ছিল আমার, সেটা মিস করি। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সিকদার আমিনুল হক, মান্নান সৈয়দ, কে না আসছে আড্ডা দিতে। সেই আড্ডাটাতো এখানে পাই না। এটা একটা শূন্যতা, আর সেটা আমি পুষিয়ে নেই কবিতার মাধ্যমে।’

আগেকার কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরতো, এখন তেমনটি দেখা যায় না?

‘এটির একাধিক কারণ আছে। ওই সময় আর এই সময় দেখতে হবে। আমরা রবীন্দ্রনাথ বা পরবর্তী সময়ে যেভাবে জীবন যাপন করেছি, এখন বিজ্ঞান আর আধুনিকতার কারণে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। ফলে আগে যে ছন্দ মিলিয়ে স্বরবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত- এখনতো সেটা নেই। অনলাইনের কারণে বা নানা ধরনের মিডিয়া এসেছে, সেখানে সবকিছুর পরিবর্তন হয়েছে। কবিতা যেহেতু মানুষের জীবন ধারণের সাথে সম্পৃক্ত সে কারণে মানুষের জীবন যেভাবে পরিবর্তন হয়েছে, কবিতারও সেভাবে পরিবর্তন হয়েছে। আমরাতো আমার দাদার বা বাবার জীবনযাপন করি না। সে কারণে পূর্বসূরিদের জীবন ও উত্তরসূরিদের জীবন আমি ধরে রাখি।’

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৮০টি। এর মধ্যে রয়েছে, তৃষ্ণার্ত জলপরী, ফেব্রুয়ারি ১৯৮২, রুণা প্রকাশনী, তবু কেউ কারো নই (নাসিমা সুলতানের সঙ্গে যৌথ), এপ্রিল ১৯৮৫, ছোটকাগজ, অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ এবং ১৯৮৯, অনিন্দ্য, মুক্তিযুদ্ধের পঙক্তিমালা, ২০০১, কলম্বিয়া প্রকাশনী, রবি ঠাকুরের প্রাইভেসি, ২০১৫, নওরোজ কিতাবিস্তান, প্রেমের আগে বিরহে পড়েছি, পাঞ্জেরি, ২০১৮, সঙ্গমের ভঙ্গিগুলো, বেহুলা বাংলা, ২০১৯, আমার সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হবে আজ, ২০২০ অন্যপ্রকাশ, পাখিদের অবিবাহিত জীবন, ২০২২, স্বরব্যঞ্জন। বর্তমানে ‘কানাডায় ১৯৭১’ নিয়ে গবেষণা করছেন।

ইত্তেফাক/এসকে