‘একটি চুমুর তৃষ্ণায় রক্তে ঢুকেছে সোনালি অসুখ, অথচ তোমার ঠোঁটেই জ্বলতে দেখেছি সে জহরত’ - সোনালি অসুখ, মাহফুজা অনন্যা। কবি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চিনি মাহফুজা অনন্যাকে। এবার তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন ঔপন্যাসিক হিসেবে। শব্দশৈলী এবার প্রকাশ করেছে কার প্রথম উপন্যাস ‘কীর্তনখোলা’।
বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে শুরুতে কিছুটা তুলে ধরছি, ‘আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট জানার পর মনেমনে খুব ক্ষুব্ধ হয় সোবহান। আবারও কন্যা সন্তানের জন্ম দেবে তার স্ত্রী শেফালি। বিষয়টি মেনে নিতে পারে না সোবহান। কিছুদিন পর তার স্ত্রী শেফালির ওয়াটার ব্রেক করলে তার বাবারবাড়ির পাশেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সোবহান জোর করেই চেপে বসে বরিশাল টু ঢাকাগামী লঞ্চে। দীর্ঘ জার্নিতে কন্যা সন্তানটি জন্ম নেয় এবং শিশুটিকে লঞ্চ থেকে পানিতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে সোবহান। পরিকল্পনা বুঝে ফেলেন শেফালি। শারিরীক আঘাত ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শেফালি মারা যায়। উপয়ান্তর না পেয়ে লঞ্চের কামরায় শিশুটিকে রেখে পালিয়ে যায় ঘাতক বাবা সোবহান। খবরটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমন নানা ঘনটায় এগিয়ে চলে উপন্যাস। আছে পৈশাচিকতা, দুঃখবোধসহ নানা ঘাত-প্রতিঘাত। এতে দারিদ্রতা, অশিক্ষা, জন্মজটিলতা, করোনাকালীন সংকট, জাতিগত প্রভেদ, চাকরি সংকট, ধর্ষণ এবং প্রেমের বিষয়গুলো দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বইমেলার শেষের দিকে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে কথা হয় মাহফুজা অনন্যার সাথে।
আপনি কবিতার মানুষ, উপন্যাস লিখলেন হঠাৎ?
‘সাহিত্যে একটি প্রচলিত কথা আছে, কবিতা সাহিত্যের সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম শাখা। কবিতা লিখছি অনেকদিন। একসময় মনে হলো, আমি সাহিত্যের সবগুলো শাখাতেই বিচরণ করার শক্তি বা মনোবল রাখি। যেদিন এমন মনে হলো সেদিন থেকেই লিখতে বসে গেলাম উপন্যাস। আমার মনে হয়েছে, যে কবিতা পারে সে সব পারে। তাছাড়া অনেকেই কবিদের অলস ভাবে এবং বলে অলসরা কবিতা লেখে। এখন অন্তত আমাকে কেউ তা বলতে পারবে না, হা হা হ !’
অনেকেই টিপ্পনি কেটে বলেন নতুন নারী লেখকের লেখায় গভীরতা কম থাকে, বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
‘লেখক লেখকই। নারী-পুরুষ বলে কিছু নেই। তাহলে তো অরুন্ধতী রায় তৈরি হতো না, সেলিনা হোসেন তৈরি হতো না, আনোয়ারা সৈয়দ হকের মতো কেউ থাকতো না। তসলিমা নাসরিন তৈরি হতো না। নারী লেখকরাও অনেক ভালো ভালো বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছেন। আসলে নেতিবাচক দৃষ্টিতে চিন্তা না করে সুদৃষ্টিতে নারীদের লেখা বিশ্লেষণ করা হলে অবশ্যই নারীদের লেখাও অনেক উপরে থাকবে বলে মনে করি।’
তোমার স্পর্শ খুঁজি ভীষণ বর্ষায়
বৃষ্টির ফোঁটায় খুঁজি শিল্পের কিরণ,
শ্রাবণকে অনুবাদ করতে গিয়ে শিল্পের সংসারে করি সহবাস,
কারণ স্বৈরিতা আমার প্রিয় স্বভাব।
- কামার্ত নগরের কামিজ।
আপনার কবিতা যেভাবে পাঠক গ্রহণ করেছে এই উপন্যাসও কী সেভাবে নেবেন বলে মনে করেন?
‘আমার বই এজন্যই পাঠক পড়বে, কারণ জীবনের খুব কোণঘেঁষা একটি কাহিনীকে উপজীব্য করে লেখা হয়েছে কীর্তনখোলা। সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণী থেকে শুরু করে শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবন, নানারকম সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়েছে। বিধবা বিবাহকে ইতিবাচক করে দেখানো হয়েছে। অনেক কিছুই আমাদের জীবনের সাথে মিলে যাবে, যাতে পাঠকের মনে হবে আশেপাশে এরকম ঘটেছে।’
উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে কোনো ঘটনা আপনাকে কি উদ্বেলিত করেছে?
‘বইটি লিখতে গিয়ে অনেক কেঁদেছি আমি। আমি সাধারণত গভীর রাতে লেখালেখি করি। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি অল্প আলোয় নীরবে লিখি। আমার কলমেই কাহিনীতে কয়েকটি মৃত্যুর ছবি আঁকতে হয়েছে। একটি চরিত্রের মৃত্যু হলে লেখক কাঁদে, কারণ চরিত্রগুলো তো লেখকেরই সৃষ্টি। তাদের সাথে যত কথা হয়, লেখকের আত্মার সাথে তা হয়। তাই যখন কোনো চরিত্রের মৃত্যু হয়, লেখকেরও অনেক কষ্ট হয়, কষ্টে বুকটা ছিঁড়ে যায় যেন! এমন করে আমি কয়েকটি রাত কেঁদেছি। নির্ঘুম কাটিয়েছি সারারাত।’
মাহফুজা অনন্যা ১৯৮২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেলার সুগ্রীবপুর গ্রামে জন্ম নেন। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি জ্ঞানার্জন ও লেখালেখিতে জীবনের পরম আনন্দ খুঁজে পান। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: সোনালি অসুখ, কামার্ত নগরের কামিজ, এবং নাভির কান্না, আশি দোররা চুম্বন এবং ত্রিভুজ ফুল শনিবার ফোটে।