সাত বছর পর আবারও কূটনৈতিক সম্পর্কে ফিরছে ইরান ও সৌদি আরব। বেইজিংয়ে চার দিনব্যাপী সমঝোতা আলোচনার পর বছরের পর বছর ধরে জমাট বেঁধে থাকা হিমশীতল কূটনৈতিক সম্পর্কের বরফ গলা শুরু হয়েছে। সমঝোতা অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে নতুন করে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা শুরু হবে। সেই সঙ্গে আগামী দুই মাসের মধ্যে উভয় দেশের রাজধানীতে খুলবে দূতাবাসের দরজা। ইরান-সৌদি সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে চীন সরকার। ফলে স্বভাবতই উভয় দেশের সরকারই বেইজিংয়ের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসায় উচ্চকণ্ঠ! বলে রাখা দরকার, ২০১৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই বড় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ হয়ে যায়। ঐ বছর সৌদি আরব শিয়া সম্প্রদায়ের একজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাসহ মাত্র এক দিনেই ৮১ জন শিয়া ধর্মাবলম্বীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর তেহরানের সৌদি দূতাবাসে হামলার ঘটনা ঘটে। তারপর থেকেই মূলত দুই দেশের সম্পর্কে ঘটে নাটকীয় অবনতি। এই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে ইরান ও চীনের টানাপোড়েন শুরু হয়। সৌদি আরবের অবকাঠামোর ওপর সাম্প্রতিককালে বেশ কয়েক দফা ভয়াবহ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য ইরানের সামরিক বাহিনীকে সৌদি সরকার দায়ী করলে টানাপোড়েন তীব্র আকার ধারণ করে। তাছাড়া ইয়েমেনে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সেখানেও দুই দেশের অবস্থান বিপরীতমুখী। পরস্পরবিরোধী পক্ষকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান ও সৌদি আরব। ইয়েমেনের যুদ্ধ একদিকে দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে বিরাট ফাটল সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে সৌদি আরবে শিয়া মুসলিমদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা নিয়েও উভয় পক্ষ লিপ্ত গুরুতর বিরোধে। যা হোক, এ ধরনের নানা হিসাবনিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এমন ধারণা ছিল, ইরান-সৌদি সম্পর্কের চাকা আগামী দিনগুলোতে কেবল পেছনের দিকেই ঘুরবে। তবে চীনের সমঝোতা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে অবস্থা পালটে গেল! বলা বাহুল্য, এ ঘটনা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘টক অব দ্য টেবিল’! এ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা, জল্পনা-কল্পনা। ইরান-সৌদি সম্পর্কের নতুন অধ্যায় এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’-এ প্রকাশিত কয়েক জন বিশ্লেষকের অভিমত পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো—
- সৌদি আরব সব ডিম একই ঝুড়িতে রাখছে না!
কারমিল আর্বিট
সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়েছে বটে, কিন্তু এ সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এমনকি, এই সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিয়ে এখনই কথা বলাটা একটু তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায় বৈকি! এ কথা সত্য, ইরান-সৌদি সম্পর্ক জোড়া লাগানোর বিষয়ে বেশ কিছুদিন ধরে দরকষাকষি চলছিল, যা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেছে। তবে এ নিয়ে অতি উত্সাহী হওয়ার কিছু নেই। ভুলে গেলে চলবে না, সৌদি আরবকে সব ক্ষেত্রেই সুবিধাবাদীর কাতারে দেখা যায়। তার নিজের ঘরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা তো আছেই, এর সঙ্গে মুসলিম বিশ্বে প্রভাব কমে যাওয়ার মাশুলও গুনতে হচ্ছে সৌদি সরকারকে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘ভেতরে ভেতরে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক’ নিয়ে একপ্রকার সংগ্রামও করতে হচ্ছে দেশটিকে। মূলত এসব কারণেই বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে সৌদি! এই কৌশল সম্ভবত তারা শিখেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে দেখে! কারণ, আমিরাত দেখিয়েছে, একই সঙ্গে ইরানের সঙ্গে শীতল অথচ সৌহার্দপূর্ণ এবং ইসরায়েলের সঙ্গেও উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলা সম্ভব! সৌদি আরব হয়তো এ ধরনের সূক্ষ্ম ভারসাম্যই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে! এক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার, দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তিসহ টেকসই নিরাপত্তা গ্যারান্টির দাবি জানিয়ে আসছে সৌদি, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তেমন একটা সাড়া পাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র কেন তাদের ঝুলিয়ে রাখছে, সে কথাও হয়তো সৌদি খুব ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারে! বস্তুত, এসব কারণেই আলাদা আলাদা ঝুড়িতে ডিম রাখার পথে হাঁটছেন সৌদি প্রিন্স! সম্ভবত সৌদি আরবের বিশ্বাস, ইরান-সৌদি সমঝোতার ফলে চীনের কাছে সৌদির গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বেড়ে যাবে। মুসলিম বিশ্বে সৌদির ভাবমূর্তি শক্তিশালী হবে। সর্বোপরি, মধ্যপ্রাচ্যের মতো ক্রমবর্ধমান গতিশীল অঞ্চলের নেতা হওয়ার পথ সুগম হবে। এক্ষেত্রে বলে রাখা জরুরি, মধ্যপ্রাচ্যের কঠিন ভূরাজনৈতিক পটভূমির ওপর দাঁড়িয়ে সৌদির এ ধরনের দিবাস্বপ্ন কতটা বাস্তবতার মুখ দেখবে, তা নিশ্চিত করে বলা কেবল কঠিনই নয়, অনেকটা অসম্ভব!
লেখক : আটলান্টিক কাউন্সিলের মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো
- সিরিয়ায় তুরস্ককে নিয়ে লেখা রাশিয়ার স্ক্রিপ্ট ফলো করছে চীন
মিশেল ডুকলোস
ইরান-সৌদি সম্পর্ক পুনোরুদ্ধারের ঘটনা চীনা কূটনীতির জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় সাফল্য। এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে স্পষ্টত চীনের ‘দীর্ঘদিনের অভিযান’ সফলতার মুখ দেখল। সৌদি আরব ও ইরান চীনের পদক্ষেপের প্রশংসা তো করছেই, উপরন্তু উভয়ের প্রতিক্রিয়াই বেশ চোখে পড়ার মতো! তবে যে যা-ই বলুন, একটা বিষয় পরিষ্কার, চীনা মধ্যস্থতাকে তথাকথিত ‘শান্তি পরিকল্পনা’ কিংবা আরো খোলাখুলিভাবে বললে, ইউক্রেন যুদ্ধে বেইজিংয়ের ‘পজিশন পেপার (ইউক্রেন যুদ্ধে চীন কোন পক্ষ নিয়েছে?)’-এর দৃশ্যমান পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা না করে উপায় নেই! লক্ষণীয় বিষয়, চীন হয়তো দেখাতে চাইছে, গ্লোবাল সাউথ শক্তিগুলোর আর পশ্চিমের পদক্ষেপের দিকে চেয়ে থাকার, তাদের ওপর নির্ভর করার দরকার নেই। মূলত আসল খেলাটা এখানেই! চীন সেই স্ক্রিপ্ট ফলো করছে, সিরিয়াসংকটের সময় যা লিখেছিল রাশিয়া। সে সময় ‘আস্তানা প্রসেস’-এর মাধ্যমে তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে সমঝোতার আয়োজন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল রাশিয়া। আজ ইরান-সৌদিকে এক কাতারে দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার পদাঙ্কই অনুসরণ করল চীন! এর পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে। প্রথমত, চীন-সৌদি-ইরান—এই ত্রিশঙ্কু ফরম্যাটের বাস্তব চিত্র আদতে কেমন হবে? ‘চীনা কূটনৈতিক অভ্যুত্থান’ এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের গভীর রাজনৈতিক রূপরেখাকে কি বাস্তবে রূপ দিতে পারবে? দ্বিতীয়ত, প্রথমবারের মতো সফলতার মুখ দেখা ‘চীনা মধ্যস্থতা’ কি কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি ‘চীনা কূটনীতির টেমপ্লেট’ ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বমঞ্চে? অনেকে মনে করতে পারেন, ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক হতাশ দেশ ‘মধ্যস্থতা’ প্রত্যাশা করে আসছিল অনেক আগে থেকেই, যা বিশ্বের কল্যাণের জন্য বেশ জরুরিও বটে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মার্কিন ও পশ্চিমা কিংবা রাশিয়া কারো কাছ থেকেই সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই এমন একটি পরিস্থিতিতে ‘সমঝোতার ডালি’ নিয়ে চীনের এগিয়ে আসাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে হয়। যা হোক, চলমান বৈশ্বিক ক্রান্তিকালে এসব বিষয়ে কম কথা বলাই বিচক্ষণতার পরিচায়ক। আগ বাড়িয়ে কথা না বলাই উত্তম!
লেখক : সিরিয়ায় নিযুক্ত সাবেক ফরাসি রাষ্ট্রদূত
- পুরোনো যুগের পরিসমাপ্তি কিংবা নতুন যুগ শুরুর সম্ভাবনা কম, তবে—
থমাস এস ওয়ারিক
সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে চীন যে ভূমিকা পালন করছে, তাতে ওয়াশিংটনের বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এমনকি এ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না। মাথায় রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে এমন কিছু দেশ ইরান ও সৌদি কূটনীতিক, নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেনদরবার করে আসছিল। এদিক থেকে দেখলে চীন এগিয়ে না এলেও কোনো না কোনো দেশ এ কাজে সফল হতোই। যা হোক, তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোড়া লাগার ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে তেমন কোনো বড় পরিবর্তন ঘটবে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না। নিরপেক্ষভাবে বললে, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা উত্তেজনা হ্রাসের উদ্যোগকে বরং প্রশংসাই করা উচিত। ইয়েমেন কিংবা আরব উপদ্বীপের চারপাশের জলসীমায় অব্যাহত সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার লাগাম টানতে চীন যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তাকে আপাতদৃষ্টিতে ভালো কাজই বলতে হবে। তবে এ ঘটনাকে তথা ইরান-সৌদি সম্পর্কের নতুন মাইলফলককে পুরোনো যুগের পরিসমাপ্তি কিংবা কোনো নতুন যুগের অবতারণা হিসেবে দেখাটা ঠিক হবে না ওয়াশিংটনের জন্য। কেননা, কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং ভূরাজনৈতিক হিসাবনিকাশের কারণেও একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখতে বাধ্য ইরান ও সৌদি আরব! বাস্তবতা হলো, আগামী দিনগুলোতেও একে অপরের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলতে বাধ্য হবে দেশ দুটি। তবে যুক্তরাষ্ট্রেরও খেয়াল রাখতে হবে অনেক কিছু। বিশেষ করে, মার্কিন কংগ্রেস ও বাইডেন প্রশাসন উভয়কেই এটা পরখ করে দেখতে হবে যে, ‘উপসাগরীয় সুরক্ষাবলয়’ নিয়ে ওয়াশিংটন যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আসছে, তার বাস্তব চিত্র ঠিক কী? এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষাবাদের নীতি ঠিক কতটা সঠিকভাবে কাজ করছে? এই অঞ্চলে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে বা আসতে চলেছে? চল্লিশ বা বিশ বছর আগের তুলনায় কোনো কিছুকে কি আলাদা বলে মনে হচ্ছে? এ কথা সবার জানা, সৌদি আরব ও ইরানের তেলের প্রধান ক্রেতা হচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র ইরান থেকে তেমন একটা তেল পায় না। সৌদি আরব থেকেও তুলনামূলক কম তেল পাচ্ছে মার্কিনরা। এ অবস্থায় সৌদি আরবের বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবিদাওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করাই এই মুহূর্তে মার্কিন কূটনীতির এক নম্বর কাজ হওয়া উচিত। হতে পারে, রিয়াদের শর্তগুলো পূরণ করা ওয়াশিংটনের জন্য কঠিন কোনো কাজ নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে এসব বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা, সৌদি-ইরান কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মধ্য দিয়ে চীন পরিষ্কারভাবে এই বার্তা দিল যে, মধ্যপ্রাচ্যে কূটনীতির হিসাবনিকাশ বেশ জটিল এবং এমন নয় যে, এই অঞ্চলে কূটনীতির রায় সব সময়ই ওয়াশিংটনের পক্ষে যাবে!
লেখক : স্কোক্রফ্ট সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটি ফরওয়ার্ড ডিফেন্স প্র্যাকটিসের সিনিয়র ফেলো
(আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন)