শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৬ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

‘সকালবেলা আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা’

আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৩, ০৩:৫৩

মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসভিবি (সিলিকন ভ্যালি) ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ গত শুক্রবার বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ইহা ছিল আমেরিকার ষোড়শ বৃহত্তম ব্যাংক। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার পর, এই ঘটনাকে খুচরা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সবচাইতে বড় ব্যর্থতা বলা হইতেছে। মূল্যস্ফীতি লইয়া সমগ্র বিশ্বই এই মুহূর্তে অস্থির অবস্থার মধ্যে রহিয়াছে। ইহা সামলাইতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বৎসর হইতে সুদের হার বৃদ্ধি করিয়া চলিতেছে। মাত্র কিছুদিন পূর্বেই এই সুদহার ছিল ফেডারেল রিজার্ভের ইতিহাসে সবচাইতে কম। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সুদের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাইতে থাকিলে সাধারণত বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি লইতে ভয় পান। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের মূল গ্রাহক ছিল প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন স্টার্টআপ, অর্থাৎ সাধারণ একটি সেবা বা পণ্য লইয়া একটি ব্যবসায়—যাহা একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় রহিয়াছে। ফলে সুদের হার বৃদ্ধি পাইলে এই ধরনের ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। গত শুক্রবার ব্যাংকটি দেউলিয়া হইবার পূর্বে মূল ঘটনাটি ঘটে গত বুধবার। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) গত বুধবার একটি ঘোষণা দেয় যে, ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্র শক্তিশালী করিতে তাহারা ২২৫ কোটি ডলার সমমূল্যের শেয়ার বিক্রয় করিবে। এই ঘোষণাই ব্যাংকটির জন্য দুঃস্বপ্ন হইয়া দাঁড়ায়। ইহাতে ব্যাংকের গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এতটাই আতঙ্ক সৃষ্টি হয় যে, পরের দিন বৃহস্পতিবার ব্যাংকটির শেয়ারের দর ৬০ শতাংশ কমিয়া যায়। আমানতকারীরা এক দিনেই তুলিয়া লইয়াছেন ৪ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। একপর্যায়ে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফেডারেল ডিপোজিট ইনসিওরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি) সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধ করিয়া নিজেরা দায়িত্ব গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়।

অনেক অর্থনীতিবিদ বলিতেছেন, কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নহে, ত্রিশের দশকের মহামন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতি কখনো এই সময়ের মতো এত অধিক নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় নাই। ব্যাংক-ব্যবস্থার ভিত্তিই হইল পারস্পরিক আস্থা। স্যার জন হিকস তাহার ‘থিওরি অব ইকোনমিক হিস্টরি’ গ্রন্থে ব্যাংক-ব্যবস্থা বর্ণনা করিতে গিয়া ‘ট্রাস্ট’ অর্থাৎ ‘আস্থা’ শব্দটি বারংবার ব্যবহার করিয়াছেন। প্রকৃত অর্থে, ব্যাংক-ব্যবস্থায় আস্থার সহিত নৈতিকতার যেই গুরুত্ব রহিয়াছে, ব্যবসার জগতে অন্য কোথাও তাহা এত অধিক প্রভাববিস্তারকারী নহে। ব্যাংক তো শুধু অন্য ব্যক্তির অর্থ সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে না, ব্যাংক এই প্রত্যাশায় অতিরিক্ত অর্থ সৃষ্টি করে যে, ব্যাংক হইতে উঠানো টাকা আবার নূতন আমানত হিসাবে ফিরিয়া আসিবে তাহাদের ব্যাংকেই। আমানত সংগ্রহ ও নূতন অর্থ সৃষ্টিতে তাহাদের সাফল্য নির্ভর করে বাজারে ব্যাংকের সুনামের উপর। সেই জন্য ব্যাংক-ব্যবস্থা আমানতকারীদের আস্থার উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। ব্যাংকের উপর অটুট আস্থা একটি শুভচক্রের সৃষ্টি করে এবং পারস্পরিক আস্থার সম্প্রসারণের ফলে অর্থব্যবস্থায় লেনদেন ত্বরান্বিত হয়। পক্ষান্তরে আস্থাহীনতা ঘটিলে দুষ্টচক্রের সৃষ্টি ঘটে—তখন ব্যাংক-ব্যবস্থায় আতঙ্ক ও টাকা তুলিয়া লইবার হিড়িক দেখা দেয়। অনেক সময় গুজব বা বিভ্রান্তির কারণেও কোনো ব্যাংকের প্রতি আস্থাহীনতা ঘটিতে পারে। ব্যাংক-ব্যবস্থায় আস্থা আজকের বিশ্বের জীবনমরণ সমস্যা।

আমরা লক্ষ করিতেছি, বিশ্বাস বা আস্থা আমাদের সার্বিক জীবনে কত অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন পূর্বে, গত ২৪ জানুয়ারি আমেরিকার শর্ট সেলিং সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের পরই তলানিতে চলিয়া আসিয়াছিল ভারতের আদানি গ্রুপের স্টক। গৌতম আদানির বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ আনিয়াছিল হিন্ডেনবার্গ। বিশাল ধস নামে আদানি গ্রুপের শেয়ারে। তবে সম্প্রতি পুনরায় আদানি গ্রুপের শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিতে দেখা যাইতেছে। ফোর্বস রিয়েল টাইম বিলিয়নেয়ারদের তালিকায় গৌতম আদানি গত ১০ দিনে বিশ্বের ধনীদের তালিকায় ৩৫ নম্বর হইতে ২৫ নম্বরে উন্নীত হইয়াছেন। অর্থাৎ আস্থা ও আস্থাহীনতা—এই জোয়ারভাটায় আমরা ভাসিতেছি। আস্থাহীনতা, জালিয়াতি কিংবা কারচুপির বিভিন্ন ঘটনা উন্নয়নশীল বিশ্বের সংশ্লিষ্ট খাতের নীতিনির্ধারকদেরও মাথায় রাখিতে হইবে। তাহা না হইলে কাজী নজরুল ইসলামের পঙিক্তগুলি সত্য হইয়া উঠিবে—‘সকালবেলা আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা।’

 

 

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন