বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩, ১৬ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক: সুতোয় গাঁথা প্রকৃতি ও ঐতিহ্য

আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৩, ১৯:১০

১৬ মার্চ শুরু হয় ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) আয়োজনে অনুষ্ঠিত এফডিসিবি বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০২৩। ঢাকার তেজগাঁওয়ের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে দুইদিনব্যাপী এই আয়োজনের সুতোর বুননে প্রকৃতি ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণার মিশেল থেকে দেখানো সংগ্রহ মুগ্ধ করেছে সবাইকে। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিভাবান ডিজাইনারদের সংগ্রহ মুগ্ধ করেছে অপেক্ষমান সবাইকে। 


মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে এফডিসিবির সভাপতি মাহিন খান তার বক্তব্যে তুলে ধরেন সূচনালগ্ন থেকে এফডিসিবির যাত্রা। প্রদর্শনীর পাওয়ার পার্টনার এপেক্স তাদের পণ্যের কালেকশন দর্শকদের সামনে তুলে ধরে। এরপর ছিল চুলের যত্নের ব্র্যান্ড স্ট্রিক্সের পরিবেশনা। মূল আয়োজনের আগে ব্র্যান্ড উজ্জ্বলা কেয়ার উপস্থাপন করে নারী ও পুরুষের চুল পড়া রোধকারী তেল, শ্যাম্পু ও ত্বক উজ্জ্বলকারী তেল। এগুলো সবই প্রাকৃতিক বলে জানান উজ্জ্বলার প্রতিষ্ঠাতা আফরোজা পারভীন। এরপর মঞ্চে একের পর এক মডেল এসে পরিচয় করিয়ে দেন এফডিসিবি'র ও ভারতের ডিজাইনারদের তৈরি চমৎকার সব পোশাকের সঙ্গে। দুই দিনের আয়োজনে অংশগ্রহন করেছেন বাংলাদেশের ১৮ জন এবং ভারত থেকে আগত ৮ জন। এ অনুষ্ঠানে সহযোগী হিসেবে ছিল বাই হেয়ার নাউ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, স্ট্রেক্স, মায়া, উজ্জ্বলা কেয়ার, ন্যাচুরা কেয়ার লিমিটেড। অনুষ্ঠানটির আয়োজকের দায়িত্ব পালন করেছে সেরা ডিজিটাল থ্রিসিক্সটি। 


জমকালো এই আয়োজনের প্রথম কালেকশনটি ছিল ডিজাইনার চন্দনা দেওয়ানের। মঙ্গল শোভাযাত্রা ও পহেলা বৈশাখকে অনুপ্রেরণায় রেখে তিনি তার সংগ্রহ তৈরি করেছেন। শাড়িতে ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন শুভ প্রতীকী মূর্তির প্যাঁচওয়ার্কসহ সুতি কাপড়ের তৈরি পাঞ্জাবি ও শাড়ি। 


দ্বিতীয় প্রদর্শনী একজন ভারতীয় ডিজাইনারের। গুঞ্জন জৈন’র ‘ভ্রিস্ক’ শীর্ষক এই কালেকশনের নাম ‘ফ্ল্যামিঙ্গো উপজাতি।’ কালেকশনটিতে দেশীয় তুষার ও মালবেরি সিল্কের বিলাসবহুল বুননে তৈরি শাড়িতে ভারতের জালা ও ইক্কাত কৌশল তুলে ধরেছেন তিনি। 


পরের কিউতে মঞ্চে এলেন আফসানা ফেরদৌসী তার ‘নীল নদীর গল্প’ শীর্ষক সংগ্রহ নিয়ে। উপস্থিত সবাই মুগ্ধতায় হাততালি দিলেন। নদীর গল্প ও জলজ জীবন তিনি পোশাকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিখুঁত নকশায়। ঐতিহ্যবাহী নকশীকাঁথা সেলাইয়ে নদীর সৌন্দর্য ও এর পরিবর্তনশীল রঙ ধরে রাখতে তিনি ব্যবহার করেছেন প্রাকৃতিক নীল রঙ। 

এরপর এলেন রিফাত রহমান তার স্প্রিং/সামার কালেকশন নিয়ে। হাল ফ্যাশনে ব্যবহৃত রঙগুলোই তার পোশাকের প্রধান আকর্ষণ।

ডিজাইনার তাসফিয়া আহমেদ ৯০ এর রোমান্টিক আবহের মাধ্যমে কালেকশন সাজিয়েছেন। জারদৌসির কাজসহ মাটির টোন, সুতির শাড়ি, আনারকলি ও পুরনো ব্লক প্রিন্টের ব্যবহার থাকায় উপস্থিত অনেকেই স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেছেন।

লেখা চিঠিকে অনুপ্রেরণা ভেবে সাদিয়া রূপা নকশা করেছেন পোশাক। কাপড়ের ওপর স্ট্যাম্প সেট করার জন্য রূপা প্যাঁচওয়ার্কসহ পাট, লিলেন এবং চেক কাপড় ব্যবহার করেন। পোশাকে তিনি প্রাকৃতিক রঙ করেছেন। 

ভারতের মেঘালয়ের ডিজাইনার ইবা মাল্লাই তার কালেকশন নিয়ে হাজির হন সাদিয়ার পর। তার ‘কিনিহো’ শীর্ষক কালেকশনে আধুনিক নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ চোখে পড়ে। ‘দায়িত্বের সাথে তৈরি করা’ মন্ত্রে অনুপ্রাণিত এই কালেকশনটিতে ইরি সিল্ক ব্যবহার করা হয়েছে। 

এবার পালা ডিজাইনার নওশীন খায়েরের। মঞ্চে হাজির হলেন ‘অরেঞ্জ ব্লুম’ কালেকশন নিয়ে।  কমলা এবং কালো রঙে প্রাকৃতিক ডাই প্রিন্ট ফুটিয়ে তুলতে তিনি নতুন শেড এবং কৌশল বেছে নিয়েছেন। কীভাবে হট ডাই বাথ ও মোম প্রতিরোধী ডাইকে গোলাপি এবং সাদা রঙের প্যাটার্ন তৈরিতে ব্যবহার করা যায় সেটা তিনি প্রথমবারের মতো খুঁজে পেয়েছেন এবং ব্যবহার করেছেন তার এই কালেকশনে। 

তরুণ ডিজাইনার ইমামা হাসান তার রিসোর্ট ওয়্যার কালেকশনে প্লিট, প্যাঁচ এবং হাতে সেলাই করা অলঙ্করণে সমসাময়িক আধুনিক ডিজাইনে উপস্থাপন করেছেন। মূলত পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরিতেই তার মনোযোগ ছিল বেশি। প্রাকৃতিক উৎস ক্যাচু, মাইরোবালান এবং নীল থেকে পাওয়া রঙ ব্যবহার করেছেন।

ডিজাইনার তানহা শেখ তার ‘রাইডিং দ্য ওয়েভস অব লাইফ’ কালেকশনে সাগরের রঙে অনুপ্রাণিত হয়ে কাপড়ের বহতা বুননে বন্দি করেছেন তরঙ্গের শক্তি ও চপলতাকে। 

মঞ্চে এলেন ভারতের ডিজাইনার রিমি নায়ক তার ‘বোটানিক্স’ কালেকশন নিয়ে। প্রকৃতির প্রাণবন্ত এবং রঙিন ফুল এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল তার কালেকশন। এই কালেকশনের পোশাকগুলো তৈরি করা হয়েছে লিভা থেকে সংগ্রহীত প্রাকৃতিক, টেকসই ও শতভাগ উদ্ভিজ্জ কাপড়ে। 

প্রথম দিনের আয়োজনের শেষ পর্বটিতে মঞ্চে এলেন বাংলাদেশের কুহু প্লামন্ডন। তিনি তার পছন্দের কাপড় মসলিনে করেছেন চমৎকার সব নকশা। 

মূল প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পর এফডিসিবি’র প্রেসিডেন্ট মাহিন ডিজাইনারদের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেন। এছাড়াও কারিগর সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্থানীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণে এফডিসিবি’র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের শেষে ঘোষণা করা হয় দ্বিতীয় দিনের প্রদর্শনীর আয়োজনের তালিকা। 


দিনের প্রথম প্রদর্শনীটি ছিল মাহিন খানের। মাহিন খানের কালেকশনের প্রাণ ছিল বাংলার ঐতিহ্যবাহী কারু এবং হস্তশিল্প। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যের ধারক কারিগরদের সাথে কাজ করা, প্রাকৃতিক উপকরণ ও কাপড়ের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নিজের সৃষ্টিশীল ভাবনা ও প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি সাজিয়েছেন তার পোশাক। 

এরপর শাহরুখ আমিন শাড়ির চিরন্তনী আবেগকে ফুটিয়ে তোলা সূক্ষ্ম মসলিন ও ক্রেপ সিল্কের উপকরণের কালেকশন উপস্থাপন করেন। সাদা ও কালো শাড়ির সঙ্গে আবেগ-সরলতা ও মেলোড্রামার অপূর্ব সমন্বয় করেন তিনি। 

তৃতীয় প্রদর্শনীতে আসেন ভারতের কলকাতা থেকে আগর পারমিতা ব্যানার্জি। সাজ ২.০ কালেকশনে বিন্দুর ভ্রমণ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি। দূর্গোপুজোয় সাদা ও সিঁদুর লাল পাড়ের ব্যবহারকে এক গীতিকাব্যে রূপ দেন তিনি। তিনি ভারতীয় তাঁতি সম্প্রদায়ের হাতে বোনা মটকা ও লিলেন কাপড় ব্যবহার করে পোশাক প্রস্তুত করেছেন। 

তারপর আসে তেনজিং চাকমার বাসন্তী রঙের কালেকশন। সৌন্দর্য ও সুগন্ধে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যকে ঠাই দিয়েছেন নিজের সৃষ্টিতে। যেন এক কাব্যিক অভিব্যক্তি ছিল তার প্রকাশে। 


তেনজিং চাকমার পরেই আসেন রুখসানা এসরার রুনি। প্রকৃতির বিশুদ্ধতা ও লালিত্যের কথা স্মরণ করাতেই নিজের সুতোর কাজে যুক্ত করেছেন সমুদ্রের ফেনা, হাতে আকা জলজ্বলে সূর্য। নিরপেক্ষ ও তামাটে প্যালেটে সাজিয়েছেন পুরো পোশাকের রঙ। 

তারপর মঞ্চে আসে মাধুরি সঞ্চিতা স্মৃতির 'দ্য সেন্ট অব স্প্রিং'। বসন্তের সতেজতা স্মরণ করাতেই পোশাকে ফোটালেন অজস্র ফুল। উপস্থিত সকল দর্শকই মুগ্ধপলকে তাকিয়ে থাকলেন বসন্তের সতেজ এই কালেকশানে। 

অবশেষে মঞ্চে আসেন ভারতে্র মিজোরামের ডিজাইনার চার্লি ম্যাথলেনার। সংস্কৃতি এবং চেতনার গভীরে প্রোথিত ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষার দায় প্রকাশ করেছেন তিনি। ডিজাইনের আবেদনময়তার পেছনে মিজোরামের রহস্যময় পাহাড়ের মোটিফ এবং তাঁতিদের সহজাত নিজস্ব দক্ষতা তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। নিজ সৃজনশীলতা দিয়ে প্রকাশ করেছেন আধুনিক ফ্যাশনের বার্তা। 

লিপি খন্দকারের কালেকশন ‘বেইজ মুড’ বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের রঙ এবং গড়নে তৈরি করেছেন বস্ত্র এবং অপ্রতিসম ছায়া অবয়ব। বাংলাদেশের স্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী সিল্কের উপর সুঁই সুতার কাজ করেছেন এবং ছাপায় ব্যবহার করেছেন জ্যামিতিক মোটিফ। ফুলের মতো মোটিফগুলো ফুটে উঠেছে হাতে করা অ্যাপ্লিকের ব্যবহারে।

পরবর্তী ডিজাইনার কামরুল হাসান রিয়াদ উপস্থাপন করেন ‘বিউটি অব গ্র্যাভিটি’ কালেকশন। নিজের কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন ফুল, পাখি এবং চাঁদের প্রতীক। চোখে পড়েছে গোলাপের ব্যবহার। দেশীয় কাপড়ে হাতে করা সেলাই ছিল এই সংগ্রহের বিশেষত্ব। 

‘দেশভক্তি’ শীর্ষক কালেকশনে ফাইজা আহমেদ তুলে এনেছেনএ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ‘ও আমার দেশের মাটি’- বাক্য। ক্যালিগ্রাফি মোটিফে গ্রামের মাটির টোনের পটভূমিতে হাতে ডাই করা দেশীয় কাপড় নিয়ে কাজে সফল হয়েছেন তিনি তার প্রমাণ উপস্থিত সকলের হাততালি। 

এই আসরের শেষ ভারতীয় ডিজাইনার সৌমিত্র মন্ডল এলেন তার ‘মুসাফির’ শিরোনামের কালেকশন নিয়ে। সমকালীন এক ভ্রমণকারী ইতিহাসকে অটুট রেখে সমসাময়িক ফ্যাশনকে ভালোবাসেন এবং জীবনকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটেই দেখতে ভালোবাসেন–এই মূলমন্ত্রে সৌমিত্র সোজা ও আড়াআড়ি রেখাকে নিজের ডিজাইনের প্রধান উপাদান বাছাই করেন। আশপাশের প্রকৃতি থেকেই এনেছেন নানা ধরনের সবুজ, বাদামি এবং আকাশি রঙ। তাঁতে বোনা বিশেষ সূক্ষ্ম লিনেন সুতায় তৈরি তার শাড়িগুলোও দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। 

রাতের শেষ আয়োজনে মঞ্চে এলেন বাংলাদেশের অসামান্য ডিজাইনার শৈবাল সাহা’র। ‘ব্যাক টু মাদার নেচার’ কালেকশনে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন প্রকৃতির সহজাত ধারাবাহিকতাকে। পুরুষের পোশাক তৈরিতে তিনি ব্যবহার করেছেন হাতে বোনা খাদি। শিবরি, খয়ের এবং হরিতকি’র মতো প্রাকৃতিক ব্যবহার করেছেন তার পোশাকে। 

শৈবাল সাহাকে ধন্যবাদজ্ঞাপনের মাধ্যমে পর্দা নামলো বাংলাদেশ ফ্যাশন সপ্তাহ ২০২৩-এর। 

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন