সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

রক্তদানে নজরুলের সেঞ্চুরি, স্বপ্ন ডাবল সেঞ্চুরির 

আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:৫৮

ছোটবেলা থেকেই বাবা নেই। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট নজরুল।  সবসময় চেষ্টা করেন ভালবাসা পাবার।

১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ভৈরব প্রেস ক্লাবে স্থানীয় সংগঠন 'বিছাসের' উদ্যোগে ঢাকা মেডিক্যাল সন্ধানী টিম যায় ফ্রি রক্তদানের ক্যাম্পেইনে, তখন অন্য বন্ধুরা সিরিয়াল দিয়ে রক্তদান করলেও নজরুলের বয়স ১৮ হতে তখনও বাকি ২ মাস। তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও দিতে পারেননি। 

তবে ঠিক ২মাস পরের গল্পটা অন্যরকম। নজরুল জানান, ২৮শে নভেম্বর আমার ১৮তম জন্মদিনে সকাল সকাল বাসে করে ঢাকা মেডিক্যাল সন্ধানী অফিসে এসে মণি আপার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, তিনি ক্লাস করে আসলে তাকে বলি আগের ঘটনা- কিন্তু উনি সব ভুলে গেছে আমার কথা আর এটাই স্বাভাবিক। তবে সেদিন ওনার হাতেই আমার ১ম রক্তদান সম্পন্ন হয়।

রক্তদানের পর রোগীর মা-বাবা যখন আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর এভাবে আদর পেতে পেতে রক্তদান এখন অভ্যাস হয়ে গেছে নজরুলের। রক্তদান শুরু থেকেই স্বপ্ন দেখেন একদিন রক্তদানে সেঞ্চুরি করব। করলেনও তাই এবার ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্নের কথা জানিয়ে বলেন, ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই- এই স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাবে। সেই থেকে চার মাস পরপর ৪৮ বার হোল ব্লাড আর প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে ১৫ দিন বা ১ মাস পরপর ডেংগু রোগী ও ক্যান্সারের রোগীকে প্লাটিলেট দিয়ে যেদিন সত্যি সত্যি সেঞ্চুরি করে ফেললাম, সেদিন মনে হল- ধুর, এইটা একটা ব্যাপার হল?
(পাশের দেশ ভারতের বোম্বে শহরে ডেংগু রোগীকে প্লাটিলেট দিয়ে অনেকেই ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ইতিমধ্যেই)

রক্ত দেওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা হয়নি। নজরুলের ভাবনায় রক্তদানের লাইন অনেক বড় হবে, আর রক্তগ্রহীতার লাইন শূন্য হয়ে যাবে- এমন একটা বাংলাদেশের জন্যই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইউরোপ-আমেরিকার মত পুষ্টি সচেতন হবে মানুষ, দেশ থেকে ক্যান্সার নির্মূল হবে- তাহলে রক্তের চাহিদা কমে যাবে একেবারেই। প্রতিটি পরিবারের সবাই ব্লাড গ্রুপ জেনে রাখবে- নিজেদের প্রয়োজনে নিজের পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন সহ সবাই এগিয়ে আসবে- রক্তের অভাবে ঝরে যাবে না আর একটিও প্রাণ। 

রক্ত দানের একটি সুন্দর স্মৃতি বলতে গিয়ে নজরুল জানায়, 'সেটা ছিল আমার ২য় রক্তদান। প্রথম দেই আমার ১৮তম জন্মদিনে ঢাকা মেডিক্যালের সন্ধানীতে গিয়ে । সুতরাং আমার রক্ত কার শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে, বোঝার কোন উপায় নেই। কিন্তু এবার আমার এলাকার এক মায়ের জন্য লাগবে। কিন্তু যেতে হবে পাশের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে। তারা পুরা ফ্যামিলি আমার সঙ্গে যাবে বড় এক মাইক্রো করে। রোগীর ছেলে তাদের বাড়ির সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। সবাই আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিচ্ছে আর খুব সম্মানের সঙ্গে কথা বলছে।  নানান রকমের খাবার দিচ্ছে। নারীরা বলতে লাগলেন- আরে বাজান, তোমার এই পাতলা শরীর থেকে রক্ত নেবে, খেয়ে একটু তাজা হয়ে নাও। গাড়িতেও পানি, স্যালাইন, ম্যাংগো জুস, ডাব আর কোকের । ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আরেক লংকাকাণ্ড, রোগীর বৃদ্ধা মা হাসপাতালের করিডোরে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্নাকাটি। আর কান্না খুব সংক্রামক জিনিস, আর সবার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে ও পানি আসে। তাড়াতাড়ি প্রস্রাবের বাহানা দিয়ে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। তারপর প্যাথলজি থেকে আমার ডাক আসলো- ব্লাড গ্রুপিং, ক্রস-ম্যাচিং আর স্ক্রিনিং এর জন্য ব্লাডের স্যাম্পল দিতে হবে। দিয়ে আসলাম, যদিও গ্রুপ আগেই জানতাম এ পজিটিভ- তবু এখানে নাকি করতেই হবে। এর মাঝে জানলাম- রোগীর জরায়ু অপারেশন করবে, ব্লিডিং নাকি বন্ধ হচ্ছে না। তাই জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হবে। উনারা নাকি ৪-৫ দিন ধরে রক্তদাতা খুঁজছেন, কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না। তারপর আসলো চূড়ান্ত ডাক- আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম রক্তদানের বেডে। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে লাল রঙের ভালবাসায় পূর্ণ হয়ে গেল রক্তের ব্যাগ। তারপর সবাই মিলে আবার এসে গাড়িতে উঠলাম- এবার তাদের অনুরোধ দুপুরে খেয়ে যেতে হবে। সকালে কি না কি খেয়েছি- তারা সন্তুষ্ট হতে পারে নাই। আমি বেচারা কি আর করব- পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে'।

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন