পুরস্কারটি তাঁর পাওয়া উচিত ছিল দু-এক দশক আগেই, যখন তাঁর বয়স ছিল পঞ্চাশ কিংবা ষাটের কোঠায়। কিন্তু সে সময় তিনি তা পাননি। অবশ্য পুরস্কার পাওয়া-না-পাওয়া সবসময় যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই পুরস্কার সবসময় যোগ্যতার নিরিখে হয় কি না—তা নিঃসন্দেহে বিতর্কের দাবি রাখে। ভাবা যায় ১৯০১ সালে সাহিত্যে যখন প্রথম নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় সুলি প্রধোম নামের এক ফরাসি লেখককে, যিনি তাঁর নিজ দেশ ফ্রান্সেই ছিলেন রীতিমতো অপরিচিত। অথচ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও তলস্তয় পৃথিবীতে তখন দারুণভাবে বর্তমান। বহুক্ষেত্রেই দেখা যায়, পুরস্কার পাওয়ার বেলায় যোগ্যতা ছাড়াও আলাদা মালমসলা লাগে। তবে বড় কথা হলো দু হাজার তেইশ সালে এসে বাহাত্তর বছর বয়সি তাপস মজুমদার নামের লেখককে বাংলা একাডেমি বিলম্বে হলেও চিনে নিতে ভুল করেনি। শুধু তাপস মজুমদারই নন, এবারের বাংলা একাডেমি পুরস্কার নির্বাচনে কর্তৃপক্ষ এমন ক’জন লেখক-গবেষককে নির্বাচিত করেছে যারা অনেক আগে থেকেই এই পুরস্কারটি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু বিলম্বে হলেও একাডেমি তাঁদের মূল্যায়ন করতে ভুল করেনি।
অবশ্য পুরস্কারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বয়স আদৌ কোনো নিয়ামক নয়। আমেরিকান আইকন গ্র্যান্ড মা মোজেজ প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন নব্বই বছর বয়সে আর ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ডোরিস মে লেসিং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন সাতাশি বছর বয়সে। তাই কে কোন বয়সে পুরস্কার পেল তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। ইতালিতে স্যান্ড্রো বত্তিচেল্লি নামের একজন অক্ষয়কীর্তির শিল্পী আছেন তা মানুষ জানতে পেরেছিল এই শিল্পীর মৃত্যুর পৌনে চার শ বছর পর, যাকে পৃথিবীর প্রায় সব বোদ্ধা এখন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কিংবা মাইকেলাঞ্জেলোর সমউচ্চতার শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। মোদ্দা কথাটি হলো স্বীকৃতি। তা একসময় এলেই হলো। এবং তাপস মজুমদার তা এবার পেয়েছেন।
বলছিলাম সাংবাদিক ও কথাশিল্পী তাপস মজুমদারের কথা। কৌলিক বিচারে তিনি কোন পর্যায়ের কথাসাহিত্যিক? সত্তর কিংবা আশি দশকের বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার হাঁড়ির খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন তিনি কত বড় মাপের লেখক। উত্সংক্ষেপে বলা যায়, ভাষার ওপর যেসব লেখকরা স্বচ্ছন্দে প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারেন, তিনি সেই ঘরানার লেখক। কলমের ডগায় যাঁরা শব্দ নাচাতে পারেন, নায়ক-নায়িকা ছাড়াই যাঁরা পাতার পর পাতা গল্প লিখে যেতে পারেন, ডায়লগ বিহীন বর্ণনামূলক গল্প-উপন্যাস লিখতে যাঁরা সিদ্ধ, কোনো স্পষ্ট কাহিনি ছাড়া একেবারে বিমূর্ত গল্প যাঁরা নির্মাণ করতে পারেন অনায়াসে, লেখক হিসেবে তাপস মজুমদার সেই গোষ্ঠীভুক্ত। বাংলা সাহিত্যে নিরীক্ষাধর্মী কথাসাহিত্য সৃষ্টি করার মতো শক্তিমান লেখকের সংখ্যা হাতেগোনা। তাঁর লেখা ‘মঙ্গল সংহিতা’ গ্রন্থটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের নিরিখেই একটি অনন্য সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্ট ‘চড়ক সংহিতার নায়ক’ কিংবা ‘শব্দকরের আকাশবাজি’ গ্রন্থদুটিই এই লেখকের জাত চেনানোর জন্য যথেষ্ট। কথাকার হিসেবে তিনি সারস্বতসমাজে বরাবরই আলোচিত এবং তাঁর স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন দু দশক আগে যখন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর রচিত ‘শবযাত্রা’ নভেলেটটি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে। তাপস মজুমদার বরাবরই লেখেন কম, কিন্তু যতটুকু লিখেছেন তা একেবারেই হয়ে ওঠে মৌলিক কথাশিল্পের সারাত্সার।
বিলম্বে হলেও অন্তত দুটি কারণে তাপস মজুমদারের বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোনো লেখক যখন একাডেমি পুরস্কার পান তখন এ প্রজন্মের নবীন লেখকরাও তাঁর সম্পর্কে জানতে এবং তাঁর লেখা পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাপস মজুমদার তাঁর বহুল আলোচিত রচনা ‘বানিশান্তার পদাবলী’তে লিখেছেন—নটী বিনোদিনীর অভিনয় দেখে নাকি পতিতপাবন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করেছিলেন ‘তোর চৈতন্য হোক’ বলে। তাপস মজুমদারের বিমূর্ত ও নিরীক্ষাধর্মী রচনাগুলো পড়ে নতুন প্রজন্মের লেখক-পাঠকরাও নিশ্চয়ই নতুন চৈতন্যে উদ্ভাসিত হবে।