শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘প্রতারক’ আনিছ ফকির অবশেষে গ্রেপ্তার

আপডেট : ১০ মে ২০২৩, ২৩:৪১

বিদেশে নেওয়ার প্রলোভন, ব্যবসায় অংশীদার করা, জমি বিক্রেতা, চাকরি দেওয়া, স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ কখনো অ্যাডভোকেট, কখনো ডিবি কিংবা কখনো ব্যবসায়ী, আবার কখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণা করতেন চৌধুরী মুহাম্মদ আনিছুর রহমান ফকির ওরফে আনিছ ফকির। অবশেষে বুধবার (১০ মে) দুপুরে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

অভিযোগ রয়েছে, এ কাজ করতে গিয়ে তিনি কখনো শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক-শিল্পপতির আত্মীয়, কখনো ব্যারিস্টারের ছেলে পরিচয় দিয়ে এসেছেন। এছাড়া নিজের পরিচয় দিতে তিনি বলেছেন, ‌‘আমার মামা ডিআইজি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কাছের লোক আমি।’ যদিও এগুলো সবই ছিলো গ্রামের মানুষকে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের জন্য মিথ্যা তথ্য ছড়ানো। এভাবে তার প্রতারণার শিকার হয়ে পথে বসেছেন কয়েক শতাধিক মানুষ। দিনের পর দিন প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা, এমনকি দোকানদার হতে স্বর্ণ, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ফার্নিচারসহ লাখ লাখ টাকার পণ্যও নিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, প্রতারণার ফাঁদ পেতে শিক্ষিত বেকার যুবকদের চাকরি দেওয়া, মধ্যপ্রাচ্যের ভিসা দেওয়া, সাধারণ ব্যবসায়ীদের দ্বিগুণ টাকার লোভ দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন প্রতিনিধি জানান, আনিসের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে বা গ্রামে বিচারের ব্যবস্থা করতে গেলে তার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়। আনিসের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অনেক নারী আছেন যাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন সময় প্রলোভন দেখানোর পাশাপাশি হয়রানিমূলক ধর্ষণ মামলাও করেছেন এই আনিস।

আনিস গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া পরিবারগুলোকে বিভিন্ন বেনামি নম্বর থেকে ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপে কল করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে আনিসকে গ্রেপ্তার করানোয় তাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে জানিয়ে এই পরিবারের সদস্যদের ‘দেখে নেওয়া হবে’ বলে ফোনে হুমকি প্রদান করা হচ্ছে।

দীর্ঘদিন যাবত এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা এই প্রতারক আনিসের নিজ গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা সদরের ফিংড়ী। তিনি চারটি বিয়ে করেছেন বলেও জানা যায়। প্রতারণার জন্য ব্যবহৃত তার ৩টি মোবাইল সিমের কোনটিই তার নিজ নামে রেজিস্ট্রেশন করা নয়। শুধু তাই নয়, নিজের পরিচয় ব্যবহারের ক্ষেত্রেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। কখনো নিজের নাম লিখেছেন চৌধুরী মুহাম্মদ আনিসুর রহমান আবার কখনো ফকির মুহাম্মদ আনিসুর রহমান। যদিও এলাকায় ফকির আনিস হিসেবে তিনি পরিচিত। 

তার নিজ এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক জীবনে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। ছিলেন যুবদলের পদে। নিজ জন্মভূমি ছেড়ে সাতক্ষীরার অপর উপজেলা শ্যামনগরে গিয়ে বিগত ৩ বছরে ঘাঁটি গড়ে তোলেন তিনি। 

পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, আনিসের প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার হলে তার বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু মামলা মিলতে পারে। 

স্থানীয় ফিংড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানান, আনিস ফকির বা চৌধুরী মুহাম্মদ আনিসুর রহমান নামে কোনো ব্যক্তি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। সুতরাং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার কোনো কারণই নেই।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সম্প্রতি আনিছুর রহমান ফকিরের নেতৃত্বে আব্দুল গাজী (৩৫), আকিজ গাজী (৩৭), আবু তালেব (৫২) , সিদ্দিক গাইন (৩২), হাকিম ফকির (৫২), ফজলু ফকির (৫৬) মিজানুর রহমান (৩২), রায়হান সরদার (২৮), রুহুল আমিন গাইনসহ (৪৩) অজ্ঞাতনামা ২৫/৩০ জন শ্যামনগর উপজেলায় এস এম মতিউর রহমানের (৭১) ৭ দশমিক ৫১ একর জমির জবর দখলের জন্য বিভিন্ন অপরাধজনক হুমকি ধমকি দেয়। এতে কোনো কাজ না হওয়ায় ধারালো লোহার রড, লোহার হাতুড়ি, শাবল, হকিস্টিক, লাঠি-সোটা এবং দেশীয় অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বুধবার তারা পুনরায় অত্র এলাকায় আসে এবং এই জমির পাশাপাশি আশেপাশের অন্যান্য জমিও দখলের চেষ্টা করে। এ সময় তাদের দখলের প্রতিবাদ করায় হামলা চালানো হয় স্থানীয়দের ওপর। এ সময় জমির সীমানা চিহ্নসহ আর বেশ কিছু ক্ষয়-ক্ষতি করা হয়। এ ছাড়া সাইফুল ওয়াদুদ নামক এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করে আনিসের অনুসারী মিজান। এ ঘটনায় জমির প্রকৃত মালিকদের কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয় বলে জানা যায়। এর আগেও একবার এই জমি দখলের চেষ্টা চালায় আনিস ও তার সঙ্গীরা। সে সময় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করলে শ্যামনগর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছানো মাত্রই তারা হত্যার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এ সময় আনিস ফকির এই জমির মালিক এস এম মতিউর রহমানকে গুম করে ফেলারও হুমকিও প্রদান করেন। যা পরবর্তীতে পুলিশের মামলায় রেকর্ডভুক্ত করা হয়।

এছাড়া বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে আনিসের।পাসপোর্ট জমা নেওয়ার সময় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কৌশলে চেক নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে উল্টো চেক প্রতারণার মামলা, অপহরণের নাটক সাজাত আনিছ।

শ্যামনগর থানার ওসি মো. নুরুল ইসলাম বাদল জানান, স্থানীয়ভাবে বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই অভিযোগ পেয়ে আসছি আমরা। তার বিরুদ্ধে এ সকল অভিযোগ মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। সর্বশেষ জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগে মামলাও হয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে একজন ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জখম করা হয়েছে। তার প্রতারণার বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত হয়েই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়া তার নিজ বাসস্থান সাতক্ষীরায় তার বিরুদ্ধে আরও মামলা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ইত্তেফাক/পিও