শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আম-নামা

আপডেট : ১২ মে ২০২৩, ১৮:৪৬

বলা হয়, মাছের রাজা রুই, শাকের রাজা পুঁই, আর ফলের রাজা আম। আম কথাটা শুনলেই প্রথমে মাথায় আসে একটা ফলের ছবি, যেটা লালচে হলুদ রঙের টসটসে রসালো এবং যার রয়েছে দিল-খোশ করা একটা মিষ্টি স্বাদ। আম আমাদের দেশের খুব পরিচিত একটা ফল হলেও ধারণা করা হয়, আমের উৎপাদন সর্বপ্রথম হয়েছিলো প্রাচীন ভারতে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে আমের প্রথম চাষ ও ফলন দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে উত্তর-পূর্বের ভারত ও মিয়ানমার সংলগ্ন এলাকায় আমের উৎপাদন প্রথম শুরু হয়। আমাদের দেশে সাধারণত রাজশাহী, চাপাই- নবাবগঞ্জ, আর সাতক্ষীরায় আমের ফলন বেশি হয়।

আম নিয়ে আছে প্রবাদ, আছে সাহিত্যও!  রবিঠাকুর, নজরুল এমনকি মধুসূদন বাবুও ছিলেন একেবারে যাকে বলে আমের পোকা। এই আমেরই রয়েছে নানান প্রকারভেদ আর গালভরা নাম। আম্রপালি, ফজলি, ল্যাংড়া, হাড়িভাঙ্গা, আশ্বিনা, খিরসাপাত, হিমসাগর আরও কতো কতো নাম। 'আ' তে আমটি আমি খাবো পেড়ে ঠিকই পড়া হয়, কিন্তু এই নামগুলোর পেছনে ইতিহাসটা কি খুব একটা জানাশোনা আছে? আজকে জানবো রসেভরা আমের গালভরা নাম এর পেছনের ইতিহাসটুকু।

ফজলি
প্রথমেই আসি ফজলি আমের কথায়। শোনা যায়,  ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে মালদহের কালেক্টর র‌্যাভেন সাহেব ঘোড়ার গাড়ি চেপে গৌড় যাচ্ছিলেন। জল তেষ্টা মেটানোর জন্য গ্রামের এক মহিলার কাছে জল খেতে চান। ফজলু বিবির বাড়ির আঙিনায় থাকা আম দিয়ে সাহেবের আপ্যায়ন করেন। সেই থেকে এই আমের নাম হয় ফজলি আম। 

ল্যাংড়া
ভারতের এক খোড়া ফকিরের নামে আমটির নামকরণ হয়েছে। ফকিরের আস্তানা থেকে এই জাতের আম প্রথম পাওয়া যায়। 

হিমসাগর 
আম হলো ফলের রাজা, আর হিমসাগরকে বলা হয় আমের রাজা। সাধারণত এর আঁশ-বিহীন, নরম-মাংসল আর বড় সাইজের জন্যেই এই আমের এতো সুখ্যাতি। আমাদের দেশের সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর আর ভারতের মুর্শিদাবাদ, নদীয়া জেলাতে এই আমের ব্যাপক ফলন দেখা যায়। হিমসাগর আমের এতোটাই সুখ্যাতি যে, ভারতে এই আমকে 'জিআই' বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

খিরসাপাত
ময়মনসিংহের মহারাজা সুতাংশু কুমার আচার্য্য বাহাদুর চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গড়ে তোলেন একটি আমবাগান। সেই বাগানেই অন্যান্য উৎকৃষ্ট জাতের আমের সঙ্গে চাষ হতো খিরসাপাত আম।

হাড়িভাঙা 
এই আমগাছটির জন্ম মালদায়। এক কৃষক মাটির হাঁড়ি দিয়ে ফিল্টার বানিয়ে গাছে জল দিতেন। একদিন রাতে ওই মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে কয়েকজন। ওই গাছে বিপুল পরিমাণ আম ধরে। সেগুলো ছিল খুবই সুস্বাদু। সেগুলো বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন ওই আম সম্পর্কে জানতে চায়। সেই থেকে আমের নাম হয় হাড়িভাঙা। 

আম্রপালি 
এই নামের পেছনে রয়েছে বিস্তর ইতিহাস। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৬০০ অব্দে প্রাচীন ভারতের বৈশালী রাজ্যে এক নগরবধূ ছিলেন আম্রপালি নামের এক সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী রমণী। আম গাছের নিচে তাঁকে কুড়িয়ে পেয়েছিলো তাঁর পালিত মা-বাবা। এইজন্যেই নাম দেওয়া হয়েছিলো আম্রপালি। নগরবধূ বলতে, প্রাচীন ভারতের রাজনর্তকীদের বোঝানো হতো। প্রায় ২৫০০ বছর পর ভারতের একদল গবেষক ১৯৭৮ সালে দশোহরি ও নিলাম এই দুইটি জাতের আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে আম্রপালি নামের নতুন এই আমের জাত উদ্ভাবন করেন। আম্রপালি দুশোহরী ও নীলম আমের চেয়ে অনেক উন্নত ও ভিন্ন এবং মজাদার। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আমটির নামকরণের জন্য প্রায় ২৫০০ বছর আগে জন্ম নেয়া 'আম্রপালি' নামের সেই বিখ্যাত নগর কন্যার নামটি নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তা কার্যকরও হয়। সেই সাথে আম্রপালি নামের তৎকালীন সমাজের জঘন্য প্রথার শিকার হওয়া  নগরবধূ কে দান করেন অমরত্ব।

গোপালভোগ
বাংলাদেশের সব জেলাতেই এই আম পাওয়া যায়। ল্যাংড়া আমের পরেই গোপালভোগের স্থান। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন কতটা সুস্বাদু। 

গোলাপখাস 
এ আম বিখ্যাত তার গন্ধের জন্য। মিষ্টি গোলাপের গন্ধ বহন করে বলে এই আমকে এই নামে ডাকার চল শুরু হয়ে যায়। প্রাচীন বাংলার আমগুলির মধ্যে গোলাপখাস অন্যতম। এই আমের গায়ে গোলাপের রঙের লালচে আভা থাকে।

আলফানসো
ভারত ও বাংলাদেশে এই আম পাওয়া যায়। পর্তুগীজ এক সামরিক বিশেষজ্ঞ আলফানসু ডি আলবাকারকির নামানুসারে এই আমের নাম রাখা হয়।


 
গৌড়মতি
 চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আম এটি। আশ্বিনা ও ল্যাংড়া—এই দুই জাতের আমের মুকুলের প্রাকৃতিক পরাগায়নে এই জাতটির উৎপত্তি হয়েছে বলে  আমটির নাম দিয়েছেন গৌড়মতি।

আশ্বিনা 
যখন প্রায় সব আম পাকা শেষ তখন নিজের রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে হাজির হয় আশ্বিনা। আশ্বিন মাসেই এই আম বেশি পাওয়া যায়। তাই নামও আশ্বিনা। 

গুটি আম 
 নিজের বাসাবাড়ির ছাদে বা বাড়ির উঠোনে এই আমগাছ রোপণ করা যায়। এর ফলের সাইজ ছোটো। তাই এমন নাম। 

দশেরি
প্রায় ২০০ বছর আগে ফকির মহম্মদ খান ওরফে গয়া মালিহাবাদির নেতৃত্বে একদল আফ্রিদি পাঠান আফগানিস্তানের সীমান্তে খাইবার গিরিপথের এক গ্রাম থেকে পেশোয়ার হয়ে ভারতে আসে। উত্তরপ্রদেশের ফারুকাবাদের নবাব মহম্মদ খানের বীরত্ব এবং যুদ্ধ বিদ্যা দেখে খুশি হন৷ বকশিস হিসেবে মহম্মদ খান ফলের বাগান করার অনুমতি প্রার্থনা করেন নবাব বাহাদুরের কাছে৷ সঙ্গে সঙ্গে তা মঞ্জুর হয়৷ ওই ফলের বাগানে যে আমগাছ লাগানো হয়েছিলো সেই আমের জাতের নাম রাখা হয়েছিলো দশেরি।

মির্জা পসন্দ
এটি মুর্শিদাবাদের আম। শোনা যায়, নবাব নাজিম ফেরাদুন জাঁ মির্জা পদাধিকারী এক কর্মীর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক করে আমের বাগান করেন। সেই থেকে আমের নাম হয় মির্জা পসন্দ। 
 
সুবর্ণরেখা
সোনালী রঙের কারণে আমটি দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। তাই এই আমের নাম  সুবর্ণরেখা।

গ্রীষ্মকাল এলেই আমাদের মাথায় প্রথম যে কথাটা মনে হয়, তা হলো, "আম খেতে হবে"! এজন্যে আমের রাজ্য রাজশাহী আর চাঁপাই-নবাবগঞ্জের বন্ধুদের কথা একটু বেশিই মনে হয় যেন! গরম তো পড়েই গেলো, আপনার রাজশাহীতে থাকা বন্ধুটিকে মনে করিয়ে দিন, আম পাকলেই যাতে খবরটা দিয়ে দেয়! আর হ্যাঁ, সাথে আমের নামের ইতিহাসটাও জানাতে ভুলবেন না যেন।

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন