বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সুপেয় পানির সংকট প্রকটতর হচ্ছে

আপডেট : ২১ মে ২০২৩, ০১:০৩

‘পানির সংকট’ ক্রমশ বড় ইস্যুতে পরিণত হচ্ছে! পানি নিয়ে নয়া উপনিবেশবাদ তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ্য হচ্ছে একটু একটু করে! প্রায় ১৪ বছর আগে গোল্ডম্যান স্যাশ্স নামে একটি আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিল, ‘পানিই হবে আগামী শতাব্দীর পেট্রোলিয়াম’। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত ধরে তাদের কথার বাস্তব রূপ পরিলক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে!

বিশ্বে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সুপেয় পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশেও এই সংকট ক্রমশ প্রকটতর হয়ে উঠছে। দেশের রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-উপরস্থ পানি না পেয়ে মানুষ এখন গভীর নলকূপ ব্যবহার করে ‘সোনালি রঙের (আর্সেনিক ও ক্ষতিকর নানা উপাদান মিশ্রিত)’ পানি পান করছে। অস্বাস্থ্যকর পানি ব্যবহারের ফলে স্বভাবতই ছড়াচ্ছে রোগবালায়। 

সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের ২০২৩ থেকে জানা গেছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ, ২০৩০ সাল নাগাদ সব মানুষের জন্য সুপেয় পানি ব্যবস্থা নিশ্চিতের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল জাতিসংঘ, প্রায়োগিক অর্থে তার কতটা বাস্তবায়ন করা গেছে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। উক্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতি বছর বিশ্বে ১ শতাংশ করে পানির ব্যবহার বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ভোক্তা আচরণে পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ একই হারে পানির ব্যবহার বাড়বে। অর্থাত্, বিশ্ব রাজনীতিতে এক উল্লেখযোগ্য ‘ইস্যু’ হয়ে উঠছে পানি। অতি সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পানির দখল নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে! পাশাপাশি আমাজন, মেকং ও দানিউবের মতো বড় বড় উৎসর পানির অংশীদারত্ব নিয়ে বিরাজিত বিবাদ মাঝে মাঝেই ফুঁসে উঠছে! সব মিলিয়ে কথাটা এই দাঁড়ায় যে, বিশ্বশক্তিগুলো ‘লিমিটেড ওয়াটার রিসোর্সের’ জন্য লড়বে—এটি অনেকটাই সুনিশ্চিত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, নিরাপদ পানির ভয়াবহ সংকটে থাকা ১০টি দেশের তালিকায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে আফ্রিকার দেশগুলো। আমরা বাংলাদেশের কথায় আসি তাহলে তার চিত্রও সুখকর নয়। 

গত ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই), ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সুইডেন দূতাবাস আয়োজিত ‘প্রয়োজনীয় পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করলেই সমাধান হবে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলনের তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি চার জন মানুষের একজন নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছে। বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ মানুষ এখনো নিরাপদ পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং ৬১ শতাংশ বাড়তি নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা পাচ্ছে না। সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)—৬ অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছাতে হবে। কিন্তু বর্তমানে দেশে নিরাপদ পানি পৌঁছাচ্ছে ৫৯ শতাংশ মানুষের কাছে। পানিতে জীবাণু-আর্সেনিক ও লবণাক্ততা থাকায় দুর্গম-উপকূলীয় এলাকা, গ্রামাঞ্চল এবং শহরের বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি সহজে পাওয়া যায় না। এসডিজি লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নিরাপদ পানির জন্য এখন কমপক্ষে চার গুণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। 

সত্যি বলতে, দেশের ৯৮-৯৯ শতাংশ মানুষ সাধারণভাবে পানির সুবিধা পেলেও গুণগত মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি এখনো সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়নি। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, এটা একটা বড় সমস্যা। ঢাকায় ঘনবসতি বলে সমস্যা আরো বেশি। পানি শোধনাগার যা আছে, তাও যথেষ্ট নয়। তবে আশার কথা হলো, সরকার এসডিজি লক্ষ্য পূরণের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা বাড়াতে প্রতি অর্থবছরে বাজেট অনেক বাড়ানো হচ্ছে। এসব খবর আমাদের আশাবাদী করে তোলে। বাস্তবিক অর্থেই, পানিসংকট এখন সবার জন্য রেড সংকেত—এই কথাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে সরকারকে। 

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

ইত্তেফাক/ইআ