শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আদিবাসীদের অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশের অবস্থান 

আপডেট : ২১ মে ২০২৩, ০১:২৩

জাতিসংঘে আদিবাসীদের অধিকারসংক্রান্ত ঘোষণাপত্র (UNDRIP) ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ বৃহস্পতিবার সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। জাতিসংঘের আইএলওর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উপজাতিদের আদিবাসী বানানোর জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে এ দেশের তথাকথিত গণমাধ্যম, সুশীল, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক। অনেক গণমাধ্যম এখানে আদিবাসী শব্দ প্রচারে যতটা উত্সাহী, ততটা কিন্তু উপজাতি শব্দ প্রচারে উৎসাহী নয়। এর পেছনেও বড় কারণ আছে। কারণ হচ্ছে, এ দেশের অধিকাংশ সুশীল, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম, এনজিও, খ্রিষ্টান মিশনারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা অর্থায়নে পরিচালিত হয়। আইএলও-১ কনভেনশনের (b) ছাড়াও আদিবাসীদের অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র (UNDRIP) বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছিল। পক্ষে ১৪৪টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা, বিপক্ষে ৪টি ভোট (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং ১১ প্রতিনিধি বিরত (আজারবাইজান, বাংলাদেশ, ভুটান, বুরুন্ডি, কলম্বিয়া, জর্জিয়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, রাশিয়ান ফেডারেশন, সামোয়া ও ইউক্রেন) ছিল। সেই  ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য অনেকগুলো অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. ভূমির অধিকার, ২. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, ৩. স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, ৪. জাতীয়তা লাভের অধিকার, ৫. জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ।

অর্থাত্, এখানে দেশভাগের করণীয়গুলোর অধিকার তাদের দেওয়া হয়েছে। তজ্জন্য বাংলাদেশের উপজাতিরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি তুলছে। মিশনারি ও পশ্চিমারা যেভাবে গাইডলাইন দিচ্ছে, ঠিক সেভাবেই এ দেশের তথাকথিত গণমাধ্যমগুলোও আদিবাসী শব্দটি প্রচার করে থাকে। গণমাধ্যমের এই  আচরণে দেশের অধিকাংশ মানুষ উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে সম্বোধন করছে। লাভ-ক্ষতি বিবেচনা না করেই আদিবাসী বলে আসছে। এটি বন্ধে রাষ্ট্রীয় কার্যকরী পদক্ষেপ অতীব জরুরি। শুধু দায়সারাভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে আদিবাসী শব্দ পরিহার করা সম্ভব নয়। তার জন্য গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। 

ঘোষণাপত্রটি আদিবাসীদের অধিকারের সবচেয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক দলিল। এটি বিশ্বের আদিবাসীদের বেঁচে থাকা, মর্যাদা ও মঙ্গলের জন্য সর্বনিম্ন মানদণ্ডের একটি সর্বজনীন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে এবং এটি আদিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য বিদ্যমান মানবাধিকারের মান ও মৌলিক স্বাধীনতাগুলোকে বিস্তৃত করে।

ঘোষণাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আদিবাসী ও টরেস স্ট্রেইট দ্বীপবাসীসহ আদিবাসীরা এর খসড়া তৈরিতে জড়িত ছিল।

জাতিসংঘের সনদ উদ্দেশ্য ও নীতির দ্বারা পরিচালিত। এই সনদ অনুযায়ী রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত বাধ্যবাধকতা পূরণে বলা হয়েছে, আদিবাসীরা অন্য সব জনগোষ্ঠীর সমান, সব মানুষের আলাদা হওয়ার, নিজেদের আলাদা মনে করার এবং সম্মান পাওয়ার অধিকার স্বীকৃতি। 

আদিবাসীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য এবং যেখানেই হোক না কেন, সব ধরনের বৈষম্য ও নিপীড়নের অবসান ঘটাতে নিজেদের সংগঠিত করে এই সত্যকে স্বাগত জানিয়েছে। নিশ্চিত যে আদিবাসীদের দ্বারা তাদের এবং তাদের জমি, অঞ্চল ও সম্পদকে প্রভাবিত করে এমন উন্নয়নের ওপর নিয়ন্ত্রণ তাদের তাদের প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রাখতে এবং শক্তিশালী করতে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন অনুসারে তাদের উন্নয়নের প্রচার করতে সক্ষম করবে। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, বৈষম্যহীনতা এবং সরল বিশ্বাসের নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও আদিবাসীদের মধ্যে সুরেলা ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়াবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস ব্যক্ত করা হয়েছে। 

বলা হয়েছে, আদিবাসী মানুষ ও ব্যক্তিরা অন্য সব মানুষ ও ব্যক্তির মতো স্বাধীন ও সমান এবং তাদের অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তাদের আদিবাসী উৎস বা পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে যে কোনো ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকার অধিকার রয়েছে।

উপরোক্ত ঘোষণাপত্রের কিছু অংশে চোখ বুলিয়ে আমরা জানতে পারলাম, পশ্চিমা দেশগুলো, এনজিও, নন-এনজিও, দাতা সংস্থা, মিশনারি ও কূটনৈতিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা তৈরি করতে বাঙালি ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মিথ্যাচার করছে। এবং এই অঞ্চল থেকে বাঙালিকে উৎখাত করতে নানা রকম ষড়যন্ত্র করছে। ১৭০০ সালের পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আশ্রয় গ্রহণ করা এবং ব্রিটিশদের হিলট্রেকস ম্যানুয়েলের ৫২ ধারামতে অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত উপজাতীয়দের বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা তথা ভূমিপুত্র হিসেবে প্রমোট করছে। এর ফলে অভিবাসী উপজাতিরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় বহন করছে। 

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরিচয় সম্পর্কে জাতিসংঘের কিছু সংজ্ঞা নির্ধারিত আছে। যারা ভূমিপুত্র কিংবা কয়েক হাজার বছর ধরে যথাস্থানে বসবাস করে বা যাদের বসবাসের ইতিহাস জানা নেই, এমনকি ঔপনিবেশিক শাসনামলের আগে থেকে বসবাস করে, শুধু তাদেরই আদিবাসী বলে। কিন্তু এ দেশের উপজাতিরা ভিনদেশি দখলদার। তাদের এ দেশে বসবাসের ইতিহাস ২০০-৩০০ বছরের পুরোনো নয়। শুধু ভাষা-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আদিবাসী হওয়া যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা উপজাতি। তাদের সঙ্গে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা যায় কেবল। উপজাতি জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা হলো—একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা, তাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদের উপজাতি বলা হয়।  উপজাতি ও আদিবাসী জনগণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইনের অপব্যবহার এবং এ দেশের সংবিধানই বা কী বলে আর আদৌ কি তারা আদিবাসী হওয়ার দাবি রাখে? বাংলাদেশের উপজাতিরা জাতিসংঘের International Labor Organization (ILO) C১৯৮৯, সাধারণ নীতি প্রথম পার্ট-১ কনভেনশনের (এ) শর্ত মোতাবেক উপজাতি। কিন্তু তারা এর শর্তাবলি মানতে নারাজ এমনকি সুকৌশলে তারা এই শর্তকে এড়িয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর (বি)কে অপব্যবহার করছে।

এর অন্যতম কারণ, ২০০৭ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করে। পূর্বে নিজেদের উপজাতি হিসেবে পরিচয় বহন করা উপজাতিরা মূলত এ জন্যই নিজেদের এখন আদিবাসী দাবি করছে।

২০০৭ সালের ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতীয়তা লাভের অধিকার আছে। মূলত, তার সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য এবং দেশভাগের জন্য (বি) শর্তাবলি পূরণ না করার শর্তেও নিজেদের আদিবাসী দাবি করছে, যা দুঃখজনক এবং রাষ্ট্র ভাগ করার গভীর ষড়যন্ত্রের আলামত। 

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধান অকার্যকর করে তারা যে আদিবাসী দাবি করছে এবং আদিবাসী প্রচারে সহায়তা করছে, তা সংবিধান লঙ্ঘনের ধৃষ্টতা দেখানোর শামিল। 

আরো স্পষ্ট করে বিশদভাবে বললে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও উপজাতি এবং আদিবাসী শব্দটির তফাত—

জাতিসংঘের International Labor Organization (ILO) C১৬৯, ১৯৮৯-এর পার্ট প্রথম সাধারণ নীতির ১ ধারার, ১ কনভেনশন প্রযোজ্য এর (ধ) শুধু উপজাতি জনগোষ্ঠীর জন্য। এ দেশের উপজাতিরা এই কনভেনশন বরাবরই এড়িয়ে যেতে চায় এবং আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ জাতিসংঘের আইএলও C১৬৯, পার্ট প্রথম খণ্ড ১ কনভেনশনের (ধ) সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান-ধারণা রাখে না। যার কারণে উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে সম্বোধন করে। 

আইএলও C১৬৯, ১ কনভেনশন প্রযোজ্য এর (a) শুধুই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য—

আমাদের দেশে কাজ করা বিদেশি এনজিও, দাতা সংস্থা, মিশনারি এবং এ দেশের তথাকথিত সুশীল, গণমাধ্যম বাংলাদেশে শুধু আইএলও C১৬৯, ১ কনভেনশন রেখে (b) কে উত্থাপন করে।

১ কনভেনশন প্রযোজ্য এর (a)তে বলা হয়েছে— স্বাধীন দেশের উপজাতি জনগণ, যাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা জাতীয় সম্প্রদায়ের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করে এবং যাদের মর্যাদা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি বা ঐতিহ্য বা বিশেষ আইন বা প্রবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; মূলত তারাই উপজাতি। ১ কনভেনশনের (b) বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য প্রযোজ্য। এ দেশের উপজাতিদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং নিজস্ব রীতিনীতি বা ঐতিহ্য কিন্তু উপজাতি জনগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে।

১ কনভেনশন প্রযোজ্য এর (a)তে বলা হয়েছে- স্বাধীন দেশের জনগণ যারা বিজয় বা উপনিবেশ স্থাপনের পূর্ব বা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রতিষ্ঠার সময় দেশটিতে বসবাসকারী জনসংখ্যা বা দেশটির অন্তর্গত একটি ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে তাদের বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত হয় এবং যারা তাদের আইনগত অবস্থা নির্বিশেষে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু বা সমস্ত বজায় রাখে, তারাই মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠী। সুতরাং ১ কনভেনশন প্রযোজ্য কিন্তু (b) বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশের প্রথম উপনিবেশ সময়ে কিন্তু উপজাতিদের বসবাস বা আগমন ছিল না। উপজাতিরা এই ভৌগোলিক অঞ্চলের বংশধর না। তারা মঙ্গোলীয় ও বার্মার চম্পকনগর থেকে এ দেশে ব্রিটিশ আমলে আগমন করেছে। সুতরাং ১ কনভেনশনের (b) বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য কোনোক্রমেই প্রযোজ্য নয়।

—রিজার্ভ বাজার, রাঙ্গামাটি

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন