রোববার, ২৮ মে ২০২৩, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

দরকার পেশাভিত্তিক স্কুল-কলেজ

আপডেট : ২৩ মে ২০২৩, ০২:১২

বর্তমানে বাংলাদেশে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষা কারিকুলাম বিদ্যমান, তাতে একধরনের ঘুণে ধরেছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। এই কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের কতটা কাজে আসছে, জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা কতটা দিচ্ছে, দক্ষ মানবসম্পদে কতটা রূপান্তরিত করছে, তা প্রশ্নমুক্ত নয়। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বিরাজমান। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এজন্য তারা ক্লাসে আসে না, ঘুরেফিরে দু-চারজন ক্লাসে এলেও তাদের মুখে কোনো জিজ্ঞাসা নেই, প্রশ্ন নেই, জানার আগ্রহ নেই। সময় পার করার জন্যই যেন তরুণেরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এতে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, সবার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে মুষ্টিমেয় মেধাবী শিক্ষার্থী, যারা জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা লাভ করবে, গবেষণা করবে, মৌলিক জ্ঞানের সন্ধান দেবে। এর জন্য প্রতি জেলা-উপজেলায় একটি করে প্রতিষ্ঠান থাকবে, যেখানে সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, যেখানে ৩০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে। বাকি ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হবে পেশাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বর্তমান স্কুল-কলেজগুলোকে ক্রমান্বয়ে পেশাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি পেশার ওপর শিক্ষার্থীদের ছয় মাস/ এক বছর/ দুই বছরের কোর্সভিত্তিক ডিপ্লোমা প্রদান করা হতে পারে। কৃষক, জেলে, দর্জি, ড্রাইভার, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, সেনিটারি মিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান, ইলেকট্রিক পণ্য মেরামতকারী, ধোপা, নরসুন্দর, কামার, কুমার, তাঁতি, কসাই, বাবুর্চি, ফটোগ্রাফার, আর্টিস্ট প্রভৃতি বিষয়ের ওপর কোর্সভিত্তিক পাঠদান ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে ডিপ্লোমা প্রদান করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে।

দেশের সব ছেলেমেয়েকে একটা মিনিমাম স্তর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক লেখাপড়া করতে হবে। হতে পারে সেটা অষ্টম বা এসএসসি পর্যন্ত। তারপর হবে পেশাভিত্তিক হাতেকলমে লেখাপড়া। স্বল্পসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য শুধু উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকবে। তাহলে দেশে কোনো বেকার থাকবে না। প্রতিটি মানুষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত হবে। তখন তারা দেশে ও দেশের বাইরে কাজের সুযোগ পাবে।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানবসম্পদ তৈরি করে জার্মানি। জার্মানিতে রয়েছে দুই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পেশা স্কুল ও সাধারণ স্কুল। জার্মানিতে অষ্টম শ্রেণি (বাংলাদেশের নবম-দশম শ্রেণি) পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক। তরপর শিক্ষার্থীরা চলে যায় পেশা স্কুলে। পেশা স্কুলগুলোতে সব ধরনের পেশা শেখানো হয়। এক স্কুলে সব পেশা নয়। এই স্কুলে এই কয় ধরনের পেশা, আরেক স্কুলে আরেক ধরনের পেশা শেখানো হয়। যারা মেধাবী, যারা সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করে, তাদেরও পেশা স্কুলে সপ্তাহে এক-দুই দিন পাঠ ও প্রশিক্ষণ নিতে হয়। জার্মানিতে চিকিত্সাবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা, আইনবিদ্যা পাশ করেই কেউ চাকরি পাবে না। চিকিত্সাবিদ্যায় পাশ করে তাকে একজন বড় চিকিত্সকের অধীনে নির্দিষ্ট সময় (তিন বছর) কাজ করতে হবে, হাতেকলমে শিখতে হবে। তারপরে হবে চাকরির পরীক্ষা। তেমনি প্রকৌশলী হতে হলে একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর অধীনে কাজ করতে হবে। আইনজীবী হতে চাইলেও অভিজ্ঞ আইনজীবীর অধীনে কাজ করতে হবে। শিক্ষক হতে গেলেও তাই। শিক্ষক হতে চাইলে কোনো একটা স্কুলে কোনো একজন শিক্ষকের অধীনে কাজ করতে হবে। ঐ শিক্ষক তাকে শেখাবেন কীভাবে ক্লাস নিতে হবে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করতে হবে, কীভাবে খাতা দেখতে হবে ইত্যাদি। এসবের পর হবে নিয়োগ পরীক্ষা। ভারী কঠিন পরীক্ষা। জার্মানিতে এমন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যার ফলে যাকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি সেই কাজে যথেষ্ট পারদর্শিতা প্রদর্শন করেন।

জার্মানির মতো ইতালিতেও লেখাপড়ার একই সিস্টেম। ইতালিতে সবার জন্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা। তারপর শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেবে, সে কী করবে। যদি উচ্চতর পড়াশোনা না করতে চায়, তাহলে সে পেশা স্কুলে ভর্তি হবে। সব ধরনের পেশার ওপর প্রশিক্ষণ ও ডিপ্লোমা নেওয়ার সুযোগ আছে। যে যেটা পছন্দ করে নেয়। আর যারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়, তাদেরও সেই সুযোগ আছে। সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি পেশা স্কুলে পেশাভিত্তিক কাজের ওপর প্রশিক্ষণ ও ডিপ্লোমা নেওয়ার সুযোগ আছে। ব্রিটেনে ও লেভেল (O Level) পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা। তার পরে সেখানে বিভিন্ন পেশার ওপর ডিপ্লোমা নেওয়ার সুযোগ আছে। আবার কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে চাইলে সেই সুযোগও আছে। তবে বাংলাদেশের মতো গণহারে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশে নেই।

উচ্চশিক্ষা কোনো অধিকার (Right) নয়, উচ্চশিক্ষা হচ্ছে সুযোগ (Opportunity)। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা যেন অধিকার। সবাই অনার্স-মাস্টার্সে ভর্তি হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি অজপাড়াগায়ের কলেজে পর্যন্ত অনার্স খুলে বসে আছে। এখানেই কি শেষ? প্রতি ক্লাসে ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি রয়েছে। কলেজে শিক্ষক নেই, বিভাগ নেই, অনার্স আছে, মাস্টার্স আছে।  ফলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসে না। আর শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হলেই কী? কোথায় বসবে, কে পড়াবে? আবার বড় কলেজগুলোতে শিক্ষক থাকলেও ছাত্রছাত্রী ক্লাসে আসে না। এলেও ঘুরেফিরে কয়েক জন আসে। ৩০০-৪০০ ছাত্রছাত্রীকে কি একসঙ্গে পড়ানো সম্ভব? বিষয়টি হাস্যকর। সবাই অনার্স ও মাস্টার্সের সনদ পায় ঠিকই, কিন্তু একটা দরখাস্তও লিখতে পারে না। নিজের নামের বানানও ভুল করে।

এদিকে শিক্ষা বোর্ডগুলোও পিছিয়ে নেই। কলেজে শিক্ষক নেই ২০ জন। ছাত্রছাত্রী ভর্তি করায় ২ হাজার জন। ফলে ক্লাস বলতে কিছু নেই। আর ক্লাসে কেউ আসেও না। শিক্ষকদেরও আগ্রহ নেই। ফলে প্রতি বছর পাশ করে যা বের হয়, তা বেকারের পাহাড়ে পরিণত হয়। দেশে এত উচ্চশিক্ষার সুযোগ না থাকলে এত বেকার তৈরি হতো না। অপ্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিয়ে বেকার তৈরি না করে সরকারের উচিত পেশাভািত্তক শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া। 

দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে কোনো পেশায় পারদর্শী লোক নেই। হোক সে দর্জি, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, ড্রাইভার, ইলেকট্রিশিয়ান ইত্যাদি। কারণ তার প্রশিক্ষণ নেই। নিজে নিজে বা কাজ করতে করতে যা শেখে। ফলে সে কাজ ঠিকমতো করতে পারে না, ভুল হয়। যেমন বাথরুমে যেখান দিয়ে পানি নিষ্কাাশিত হবে, টাইলস বসানোর সময় রাজমিস্ত্রি সেই স্থান ঢালু না করে উঁচু বা সমতল করে টাইলস বসিয়ে দেয়। মিস্ত্রির ভুলের জন্য বাথরুমে বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি হয়। মিস্ত্রি ভুল করবেই। কারণ এ বিষয়ে তার কোনো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেই। দর্জির কাছে যাবেন, সেখানেও একই অবস্থা। সে ভুল করবে, কাপড় নষ্ট করবে, জামাকাপড় ঠিকমতো বানাতে পারবে না। কারণ এ বিষয়ে তার প্রশিক্ষণ নেই। আমাদের দেশে সব পেশার কাজ চলে প্রশিক্ষণবিহীন।

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে কেরানি তৈরির ফ্যাক্টরি। বাল্যকালেও আমার মনে প্রশ্ন জাগ্রত হতো যে, স্কুল-কলেজে পড়ে সবাই যদি চাকরি করে আর মাদ্রাসায় পড়ে সবাই যদি হুজুর হয়ে যায়, তাহলে দেশের উত্পাদনমুখী কাজ করবে কারা? এই প্রশ্ন আমার এখনো। আমি মনে করি, জার্মানির ন্যায় আমাদের দেশেও কর্মমুখী শিক্ষা দরকার। সে জন্য প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে হবে। বিদ্যমান স্কুল-কলেজগুলোকে পেশাভিত্তিক স্কুল-কলেজে রূপান্তরিত করতে হবে। এক দিনে সব হবে এমন নয়। আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, এটা আমরা করব। তারপর ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিদ্যমান ধাঁচের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর গড়া যাবে না এবং গড়ার অনুমোদনও দেওয়া যাবে না। প্রতি জেলা-উপজেলায় একটি করে ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করা একান্ত দরকার। সেখানে শিক্ষার্থীরা গাড়ি চালানো, গাড়ি চালানোর নিয়ম, গাড়ি মেরামত, যাত্রীর সঙ্গে আচরণ ইত্যাদি শিখবে। ড্রাইভিং স্কুলই নেই, কোথা থেকে ড্রাইভাররা ভালো গাড়ি চালানো শেখবে? মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ শিখবে? যে ড্রাইভারের হাতে অনেক মানুষের প্রাণ, সেই ড্রাইভের প্রশিক্ষণের জন্য ড্রাইভিং স্কুল নেই—এটা দুঃখজনক। প্রতি পেশার জন্য পেশাভিত্তিক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন