মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নজরুলের স্মৃতিধন্য তেওতা রাজবাড়িতে একদিন

আপডেট : ২৩ মে ২০২৩, ১৩:৪৫

সকাল ৮টা। আমাদের চার চাকার গাড়ি ছুটে চলছে নতুন গন্তব্যে। সাথে আছি আমি, প্রকৃতি বাংলাদেশ’র সুজন সেন গুপ্ত আর তার দলবল। বারে শুক্রবার, তাই সবার চোখে আলসে ঘুম নেমেছে। আমি আর আমাদের পাইলট মামুন ছাড়া সবার চোখই বন্ধ। যান্ত্রিক ঢাকার পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। রাস্তায় যানজট কম, তবে খালি রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে কিছু মিনিবাস প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এদিকে গাড়ির ভেতরেই বলাই ভাই বিকট শব্দে নাকডাকা শুরু করলেন। আমি কোনো উপায় না দেখে গাড়িতে সিডি প্লেয়ার চালাই।

আমাদের পাইলট সাহেবের আবার সব পুরনো দিনের গানের কালেকশন। মান্না দে’র কণ্ঠে অসাধারণ সেসব গান বেজে চলেছে... কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই... , দ্বীপ নিভে গেছে..., আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা...। টঙ্গী এসে আমাদের গাড়ি থামল। ফিলিং স্টেশনে ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল নয়টা। সবাই গাড়ি থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলেন। এদিকে সবারই কম বেশি ক্ষুধা লেগেছে। আমাদের মাঝে সবচেয়ে কম বয়সী আনন্দ বলে উঠল— ‘মামারা, সকালে তো কিছুই পেটে যায় নাই। খাবার দিবেন না? যে খাবার সাথে বোঝাই করে এনেছেন বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না।’

আমিও আনন্দের কথায় সায় দিলাম। শেষ পর্যন্ত সবাইকে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হলো। খাবার তালিকায় বাংলাবাজারের বিখ্যাত চৌরঙ্গীর পরোটা ভাজি;  অসাধারণ টেস্ট। তবে এর কৃতিত্ব সব পৃথুর, সে সকালের খাবারের দায়িত্বে ছিল।  যাই হোক, সকালে ভরাপেট আপ্যায়নের পর গাড়ি ছুটে চলল আব্দুল্লাপুর, আশুলিয়া দিয়ে আমাদের ভ্রমণ গন্তব্যে।

সে কি! বলাই তো হলো না— আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত তেওতা জমিদার বাড়ি। দেশের পুরাকীর্তি স্থাপনার মধ্যে মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাস্তার পাশে বড় বড় কলকারখানা, গার্মেন্টস পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি।

দেখতে দেখতে এসে পৌঁছালাম আমাদের গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নামার পর প্রকৃতি বাংলাদেশ’র সুজন সেন গুপ্ত এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস আমাদের মাঝে তুলে ধরলেন। শিবালয় উপজেলার যমুনা নদীর কূলঘেঁষা সবুজ-শ্যামল গাছপালায় ঢাকা তেওতা গ্রামটিকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে জমিদার শ্যামশংকর রায়ের প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মঠটি। এক সময় জমিদারের বাড়ির আঙিনার এই মঠকে ঘিরে দোলপূজা আর দুর্গাপূজার রঙিন উত্সব হতো।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার এই তেওতা গ্রামটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী প্রমীলার স্মৃতি জড়িয়ে থাকায়। তেওতা গ্রামের মেয়ে প্রমীলা। জমিদারবাড়ির পাশেই বসন্তকুমার সেন আর গিরিবালা সেন দম্পতির মেয়ে আশালতা সেন বা প্রমীলা নজরুল। ছন্নছাড়া, ভবঘুরে নজরুল কয়েক দফায় এসেছিলেন এ গ্রামে। তবে জনশ্রুতি হয়েছে, ১৯২২ সালে প্রমীলার সাথে একবার এসেছিলেন। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে নজরুলের লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশ হলে ব্রিটিশ সরকার তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। তখন প্রমীলাকে নিয়ে তেওতা গ্রামে আত্মগোপন করেন নজরুল। আত্মগোপনে থাকতে এলেও দুরন্ত নজরুল অবশ্য ঘরের কোনে বসে থাকেননি। যমুনার ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা সবুজ-শ্যামল পাখিডাকা তেওতা গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন। গান, কবিতা আর অট্টহাসিতে পুরো গ্রামের মানুষকে আনন্দে মাতিয়েছেন। কখনও-বা জমিদার বাড়ির শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে রাতের বেলায় করুণ সুরে বাঁশি বাজিয়ে বিমোহিত করেছেন রাতজাগা গ্রামের মানুষকে।

জমিদার কিরণ শঙ্কর রায়ের আমন্ত্রণে একবার নজরুল তার অতিথি হয়ে আসেন। আর সে সময়ই নজরুল এবং প্রমীলার দেখা হয়েছিল। জমিদারবাড়ির পাশের বাড়ির বসন্তকুমারের মেয়ে দুলি (প্রমীলা) ছিলেন তখনকার জমিদার কিরণ শঙ্কর রায়ের স্নেহধন্য। বেড়াতে এসে নজরুল জমিদারবাড়িতে প্রতি রাতেই গান-বাজনার আসর বসাতেন। আর সেখানে একমাত্র গায়ক ছিলেন নজরুল। দুলি তখন মাত্র কয়েক বছরের বালিকা। নজরুল গানের ফাঁকে ফাঁকে পান খেতেন। আর দুলির দায়িত্ব ছিল তার হাতে পান তুলে দেওয়া। হয়তো এর মাধ্যমেই নজরুল প্রমীলার পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে।

বিয়ের পর তেওতার জমিদার কিরণ শঙ্কর রায়ের আমন্ত্রণে নজরুল নববধূকে নিয়ে আবার তেওতায় আসেন। প্রায় দুই সপ্তাহ থাকার সময় জমিদারবাড়িতে নজরুলের গান ও কবিতার আসর বসতো। দর্শকের আসনে জমিদার পরিবারের পাশে প্রমীলাও থাকতো। আর নজরুল যখন '‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ....’, অথবা ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেব খোঁপায় তারার ফুল....’  গান গাইতেন তখন লজ্জায় রক্তিম হতেন প্রমীলা।

ভবঘুরে জীবনে নজরুল যেখানেই গেছেন সেখানেই কিছু না কিছু রচনা করেছেন। তেওতার স্মৃতি নিয়েও তিনি অনেক কবিতা গান সৃষ্টি করেছেন বলে নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলামের গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। এমনই একটি হচ্ছে নজরুলের ‘লিচু চোর’ কবিতা।

তেওতার জমিদারদের স্থানীয়ভাবে বলা হতো বাবু। আর তাদের বিশাল পুকুর ঘিরে তালগাছ থাকায় বলা হতো তালপুকুর। প্রাচীর ডিঙিয়ে এই পুকুর পাড়ের গাছ থেকে একটি বালক লিচু চুরি করতে গিয়ে মালি ও কুকুরের তাড়া খাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে নজরুল এই কবিতাটি রচনা করেছেন বলে স্থানীয়রা মনে করেন বলে রফিকুল ইসলাম তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও তেওতা গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনা নদীর স্মৃতিতে বেশ কিছু গান ও কবিতা লিখেছেন।

আমাদের আজকের ভ্রমণের প্রধান সুজন সেন গুপ্তের বর্ণনার পর আমরা রাজবাড়ি দেখা শুরু করলাম। জমিদার বাড়িটি এখনো তার কাঠামোতে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও ক্ষয়ে গেছে এর ইটের দেয়াল। বাড়ির সামনে বিশাল একটি পুকুর। এই পুকুরের জল তরঙ্গে পুরো রাজবাড়ির অবয়ব দর্শন করা যায়। আরও একটি পুকুর পেলাম আমরা ভেতরে; কিন্তু খুবই করুণ অবস্থা তার। বাড়ির সামনে আছে একটি বহুতল মন্দির। কারুকাজময় মন্দিরটি বিলীন হবার পথে। এখনো যেটুকু সৌন্দর্য অবশিষ্ট রয়েছে তার আকর্ষণও কম নয়।

 

তেওতা রাজবাড়ি দেখা শেষে আমরা আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম। বিকেল পাঁচটায় তেওতা জমিদার বাড়ি দেখে আমরা আরিচা ঘাটে এসে টাটকা মাছ-ভাত-ডাল দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। নদীর পাড়ে শেষ বিকেলটা কাটিয়ে আমরা ফিরতি পথ যখন ধরলাম, তখন সন্ধ্যা মিলিয়ে গিয়ে রাতের ঝাঁপি চারপাশে।

রাত নয়টা নাগাদ ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে যখন বাসায় পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় দশটা।

যেভাবে যাবেন
কয়েকটি পথ ধরে আপনি যেতে পারবেন তেওতা রাজবাড়ি। ঢাকা থেকে আরিচার দূরত্ব ৯০ কি. মি.। ৩ ঘণ্টায় বাসে যেতে ভাড়া দিতে হবে ৮০ টাকার মতো। গাবতলী থেকে যাত্রীসেবা, বিআরটিসি, পদ্মা লাইন ইত্যাদি বাসে আরিচা ঘাট যেতে পারবেন। আরিচা ঘাট থেকে রিকশায় ২৫-৩০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যাবে তেওতা জমিদারবাড়ি।

অথবা ঢাকা থেকে বাসে আরিচা ঘাট এসে নামতে হবে। এরপর সিএনজি অথবা রিক্সা যোগে তেওতা যেতে হবে। এছাড়া নদীপথেও আসা যাবে। এজন্য নৌকায় আরিচা ঘাটে এসে নামতে হবে। যমুনা নদী দিয়ে বাংলাদেশের যেকোনো পয়েন্ট থেকে তেওতা জমিদারবাড়ি আসা যাবে। ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করেও যেতে পারবেন, ভাড়া লাগবে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা।

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন