রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

একটি সামাজিক ব্যাধি ও সন্তানের ভবিষ্যৎ

আপডেট : ২৮ মে ২০২৩, ০০:০২

সম্প্রতি পত্রিকার পাতা খুললেই পরকীয়ার রগরগে খবর চোখে পড়ে। পাঠকেরও এ ধরনের খবরের প্রতি একটু আগ্রহ বা ঝোঁক বেশি। তাই তো মার্কিন সংবাদজগতের অন্যতম একচেটিয়া অধিপতি র‍্যানডল্ফ হার্টের মতে, যা গুরুত্বপূর্ণ তা সংবাদ নয়, যা আগ্রহোদ্দীপক তা-ই সংবাদ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর সব সমস্যা মূলত আগ্রহোদ্দীপক নয়। কারণ, যা নাটুকে নয়, মূলত যা ক্লাইমেক্স সৃষ্টিতে অপারগ তা আদৌ খবর নয়। খবর হচ্ছে, ডায়ানার দাম্পত্য সংকট, কিশোরীটি কুমারী মা হলে। সংগ্রামী নারীটি ধর্ষণের শিকার হলে কিংবা পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে দুই সন্তানের জননী প্রেমিকের হাত ধরে পলায়ন করলে ইত্যাদি। 

আসলে, সমাজে ‘পরকীয়া’ শব্দটিকে আমরা অনেকেই স্ত্রীলিঙ্গ ভেবে কেবল নারীদেরই দোষারোপ করি। অনেকের ধারণা, পরকীয়ার কারণ মূলত নারীরাই। কেন বলছি এই কথা, সমাজে যে স্ত্রীর স্বামী পরকীয়া করে সে স্ত্রী তার স্বামীকে দোষারোপ করে না। উলটো স্বামীর প্রেমিকাকেই দায়ী করেন। আবার যে স্বামীর স্ত্রী পরকীয়া করে, সেও নিজের স্ত্রীকেই দায়ী করে; কিন্তু প্রেমিক পুরুষটিকে নয়। একজন বিপথগামী সন্তানের জন্য সমাজ মাকেই দোষারোপ করে, বাবাকে নয়। স্বামীরা ঘুষ-দুর্নীতি করে, এটাও নারীর ইন্ধন ও  উত্সাহে করেছে বলে সমাজে চাউর হয়। একজন পুরুষ ঘরে সুন্দরী স্ত্রী রেখে অবৈধ যৌন কাজে লিপ্ত হলেও ব্যক্তির স্ত্রীকেই পরিবার, সমাজ দোষারোপ করে। কী আশ্চর্য! পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সমাজই তাদের স্বামীর পাপকার্যের জন্য দায়ী করে তার স্ত্রীকেই। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী দোষে জর্জরিত অবস্থায় সমাজে বসবাস করছে। হায় রে সমাজ! হায় রে, অবলা অর্বাচীন নারী! যে নারীর দুমুঠো ভাত আর পরনে লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্রের বিনিময়ে সারা দিনমান খাটাখাটুনি করে, যিনি বড়জোর গায়ে গহনা পরা ছাড়া এবং স্বামীগর্বে গরবিনি হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। অথচ তার ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলি।  

আর এসব দোষারোপের খড়্গ মাথায় নিয়েই আমাদের দেশের মেয়েরাও বিয়ের পিঁড়িতে বসে। আসলে বাংলার নারীরা জঙ্গলের গাছপালার মতোনই নিরীহ, নির্বিরোধী। এবার জেনে নিই পরকীয়া শব্দের অর্থ কী এবং এর পুংলিঙ্গ শব্দটিই-বা কী? প্রয়াত শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের মতে, পরকীয়া মানে অন্যের। বিশেষত পরস্ত্রীর সঙ্গে পুরুষের প্রেম। এর পুলিংঙ্গ শব্দটি পরকীয়। তার অর্থও অন্যের, বিশেষত পরপুরুষের সঙ্গে নারীর প্রেম। কিন্তু আমাদের পত্রপত্রিকায় উভয় অর্থেই পরকীয়া শব্দের ব্যবহার চলছে। এসব ক্ষেত্রে অসম বয়স, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় বাঁধা এসব নিয়ে চলে কানাঘুষা। কখনো-সখনো দেনদরবার এমন কী আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তবে পরকীয়া অতীতেও ছিল। তখন মিডিয়া ছিল না বিধায় কানাঘুষা পাঁচকান পর্যন্তই সীমিত ছিল। এখন পরকীয়ার রমরমা খবর দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে মিডিয়ার বদৌলতে। 

উদ্বেগের বিষয় হলো, পরকীয়াকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়েছে প্রতিনিয়ত। বেড়েছে একে কেন্দ্র করে অপরাধপ্রবণতাও। যেমন, নিজ সন্তানকে পথের কাঁটা ভেবে খুন করার ঘটনাও ঘটেছে। আরো ঘটেছে স্বামী স্ত্রীকে খুন, স্ত্রী স্বামীকে খুন করার ঘটনাও। কেননা,  পরকীয়ায় আসক্ত নারীরা পরকীয়ার সার্থক রূপদানে মরিয়া হয়ে ওঠে। তখনই তাদের আসক্তি মন হত্যার মতো অপকর্ম করতে এতটুকু টলে না। আর একশ্রেণির পুরুষ নিজের স্ত্রীর ওপর সতিনের খড়গ মাথায় ঝুলিয়ে মজা লুটে। কারণ, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতূহল বেশি। তাছাড়া এসবে তাৎক্ষণিক আনন্দ দেয় সত্য, তবে এর ক্ষতিকর প্রভাবে দুই-দুইটা পরিবারে রোপিত হয় অশান্তির বিষবৃক্ষ, যা আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হয় পরকীয়ার আসক্ত দুটি নর-নারীর ত্যাগ করা সংসারের সন্তানেরা। বাবা-মায়ের পরকীয়ার খেসারত দিতে গিয়ে বিষণ্ণতাকে জীবনের অনুষঙ্গী করে নেয়। আর স্ত্রী ত্যাগী সংসারের নিরপরাধ স্বামী বেচারা মনঃকষ্টে নিজেকে আত্মগোপনে রাখে। স্বামীর পরকীয়ার উপহার সতিনের জ্বালা একমাত্র ভুক্তভোগীই বোঝে। সহ্য করতে না পেরে অনেক স্ত্রী স্বেচ্ছায় সংসার ত্যাগ করার ইতিহাস এখন ঘরে ঘরে।  

পরকীয়া সংসারে আদৌ কোনো সুখ থাকে না। দুটি নর-নারীর অনৈতিক চাওয়া পূরণে সমাজে বাড়ছে ব্রোকেন পরিবার। বাড়ছে সিংগেল মাদারের তকমা লেগে থাকা ডিভোর্সি নারীর সংখ্যাও। ফলে ব্রোকেন পরিবারের সন্তানরা হতাশা কাটাতে অপরাধজগতে পা বাড়াচ্ছে। এতে বাড়ছে কিশোর মাদকসেবীর সংখ্যাও। তাছাড়া এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত হতাশাগ্রস্ত সন্তানদেরই মাদক ব্যবসায়ীরা মাদকদ্রব্যের ভ্রাম্যমাণ সাপ্লায়ার হিসাবে ব্যবহার করে। শেষমেশ তারাও কেউ কেউ আবার রাতারাতি মাদকসম্রাট বনে যায়। আর এদিকে ঘরমুখী সন্তানরাও মানসিক টানাপড়েনে একাকিত্বে ভোগে। তারা সামাজিকভাবে এতিমের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে পারে না কিছুতেই। মাতৃ কিংবা পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত—এসব সন্তানরা কোণঠাসা হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। তাই বলছি, জীবন তো একটাই। তাই নিজের অনৈতিক ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে হতাশার কাদাজলে হাবুডুবু সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যেতে দেবেন না। এতে করে আর যা-ই হোক মানসিক সুখ এবং স্বস্তি কোনোটাই পাওয়া যায় না। 

সমাজে পরকীয়ার ফল সুখকর হয় না। একটা সময় আসে যখন অনুশোচনায় কাতরাতে হয়। তখন সংশোধনের আর কোনো সুযোগই থাকে না। তাহলে কেন সন্তানের মহামূল্যবান জীবন নষ্ট করা? সুতরাং নিজের বোধ বিবেচনাকে জাগ্রত করুন। একবার নয়, শতবার নয়, সহস্রবার ভাবুন। নিবিষ্টচিত্তে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করুন। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। সমাজ ও ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতাবহির্ভূত জীবন কোনোক্রমেই সুখকর নয়, এটাই বাস্তবতা। 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক 

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন