রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নজরুল ও বঙ্গবন্ধু : অভিন্ন স্বপ্নদ্রষ্টা

আপডেট : ২৮ মে ২০২৩, ০০:১৭

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর যোগ ছিল। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের পেছনে যে নামটি জড়িত, তা হলো কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাই তো কবির ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে (১৯৭২ সালের ২৪ মে) সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বাধীন বাংলাদেশে তাকে ফিরিয়ে আনেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু জানতেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কবি নজরুল ছিলেন অবিরাম প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা ও গান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উজ্জীবিত করে ভীষণভাবে। 

বাঙালির চেতনা ও মননে এই দুই মহান পুরুষের আবির্ভাব ছিল অনেকটা ধূমকেতুর মতো। দুই জনেই ছিলেন স্বাধীনতার প্রবাদপুরুষ। আপামর বাঙালি ব্যাপক উজ্জীবিত হয় এই দুই স্বাধীনতাকামী মহান পুরুষের দ্বারা। ‘বাঙালির জয় হোক’ বলে যে মুক্তির কথা কবি নজরুল লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই ইচ্ছাকে পূর্ণতা দিলেন ‘জয় বাংলা’ বলে। দুই জনেই আজীবন সংগ্রাম করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে। সাহিত্যের কবি কাজী নজরুল, আর রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু। 

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছরপূর্তিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছিলেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানসিকতার দিক থেকে সমান্তরাল অবস্থানে রয়েছেন। তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল শোষণহীন বাংলাদেশ গড়া। নজরুলও চেয়েছেন বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে। দুই জনের স্বপ্ন ছিল এক ও অভিন্ন। দুই জনেই ছিলেন বিদ্রোহী। এক জন সাহিত্যে, অন্য জন রাজনীতিতে। এজন্য এক জনকে বলা হয় ‘পোয়েট অব লিটারেচার’, অন্য জনকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’।

কবিকে অসম্ভব শ্রদ্ধাভরে দেখতেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির জয়ে কবির জন্মোৎসব দেশে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় বিদ্রোহী কবিকে ঢাকায় আনা হয়। ‘হে কবি’ সম্বোধন করে নজরুল ও তার পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লেখেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু! 

চিঠির বিবরণে লেখা হয়, ‘আমি আমার বন্ধু ও সহকর্মী জনাব মতিউর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক জনাব মোস্তফা সারওয়ারকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। অনুগ্রহপূর্বক আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। মুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণ ও আমার পক্ষে আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার জন্মবার্ষিকীতে আপনার আদর্শে বাংলাদেশকে সিক্ত হতে দিন। আমরা বাংলাদেশে সাগ্রহে আপনার আগমনের প্রতীক্ষা করছি। আমি আশা করি, আপনি অনুগ্রহ করে আসবেন। জয় বাংলা।’ 

বাংলাদেশে আসার পর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘কবিভবনে’, ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের ৩৩০/বি নম্বরের একটি দ্বিতল বাড়িতে। ধানমন্ডিতে নজরুলের জন্য এই বিশেষ বাড়িটিও রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির খুব কাছেই ছিল নজরুলের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়িটি। এই বাড়িটি পছন্দ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। ২৪ মে নজরুল পা রাখলেন খোলামেলা এই বাড়িতে, সবুজ ঘাসের আঙ্গিনা কবিকে মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশে আছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে তার ভবনে এলেন। তার হাতে বিশাল ফুলের ডালি। গভীর শ্রদ্ধাভরে পুষ্পমালা পরিয়ে দিলেন কবিকে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব কবির হাতে তুলে দিলেন নিজ হাতে অতি যত্নে বানানো ফুলের তোড়া। বঙ্গবন্ধু পরম স্নেহে বারবার হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন কবির মাথায় ও পিঠে। নির্বাক কবি অপলক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। হাত বাড়িয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বললেন বঙ্গবন্ধুকে। বাকশক্তিহীন সে মুখের ভাষা বোঝা গেল না। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কবির সান্নিধ্যে সময় কাটান বঙ্গবন্ধু এ সময়ের স্মৃতিচারণে কবির নাতনি খিলখিল কাজী লিখেছেন, ‘... এর কিছুক্ষণের মধ্যে সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু হাসি মুখে দাদুকে শ্রদ্ধা জানাতে এলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বাবা ও চাচা শ্রদ্ধাভরে দাদুর কাছে নিয়ে গেলেন। ... তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন দাদুর প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধাবোধ ও অফুরন্ত ভালোবাসা।’

বিদ্রোহী কবিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কবি পরিবারের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কবির ৭৩তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে নজরুল একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাণী দিয়েছিলেন এই বলে, ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার।...বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধুলায়।’

মূলত এক অভিন্ন চিন্তাচেতনা ও স্বপ্নের নায়ক ছিলেন নজরুল ও বঙ্গবন্ধু। জাতি-ধর্মের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের দৃঢ়অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন এই দুই মহান নেতা। বিদ্রোহী কবি উচ্চারণ করেন ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ’। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাঙালি-অবাঙালি হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের’। 

বিদ্রোহী কবি ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতির রজত-জুবিলি অনুষ্ঠানের ভাষণে বলেন, ‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি’। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চের ভাষণে বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই’।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার শেষাংশে কবি বলেন ‘যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না, বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত’। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে লড়াইয়ের ডাক দিয়ে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে নজরুলের গানকে রণসংগীত হিসেবে মর্যাদা দেন। নজরুল ও বাংলাদেশকে এমনি করে একীভূত করেছিলেন বাঙালির মহানায়ক। অবাক বিস্ময়ে লক্ষণীয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনিরা সপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। কবি কাজী নজরুলও মৃত্যুবরণ করেন এর ঠিক পরের বছর সেই আগস্ট মাসেই (’৭৬-এর ২৯ আগস্ট)!

বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুল ইসলামের তুলনা করতে গিয়ে খিলখিল কাজী একজনকে বলেছেন মহাকবি এবং অন্যজনকে মহানেতা। খিলখিল কাজীর ভাষায় এই মহাকবি ও মহানেতা দেশের জন্য দেশের মানুষের কল্যাণে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক এবং স্বতন্ত্র ও এককভাবে বাঙালির প্রাণে আজীবন স্পন্দিত হতে থাকবেন, যার কোনো ক্ষয় নেই। 

লেখক : পুলিশ সুপার, চুয়াডাঙ্গা

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন