সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সংস্কারগুলো কতটা বাস্তবমুখী

আপডেট : ৩১ মে ২০২৩, ০০:০৫

প্রতি বছর ঘোষিত বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তার অধিকাংশই বছর শেষে অবাস্তবায়িত থেকে যায়। দেশের অর্থনীতিতে এটা একটি জটিল সমস্যা। বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে। কারণ রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তা বাস্তবসম্মত নয়। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য মোটা দাগে কোনো সংস্কার কার্যক্রমও সাম্প্রতিক নিকট অতীতে গ্রহণ করা হয়নি। ফলে অনেকটা গতানুগতিকভাবে চলছে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম। কিন্তু রাজস্ব পদ্ধতি হালনাগাদ ও আধুনিকায়ন করা না হলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো যাবে না। রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা হালনাগাদ ও আধুনিকায়ন করতে গেলে কোনো কোনো মহল থেকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। 

তারা মনে করেন, রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কর প্রদানের ক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে যাবে। রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থায় যে সামান্য সংস্কার করা হয়েছে, সেগুলোও বড় ধরনের কোনো সুফল দিতে পারেনি। আমাদের অর্থনীতির আকার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ সেই তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি। ফলে এখনো কর-জিডিপি রেশিও আমাদের দেশে অনেক কম। চলতি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অঙ্গীকার রয়েছে। চলতি অর্থবছরে কর আদায়ের পরিমাণ জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদনকালে এ মর্মে শর্ত দিয়েছে। এই অবস্থায় সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চলেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে করসুবিধা বা ছাড় দেওয়ার কারণে সরকার বড় ধরনের রাজস্ব হারায়। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য করসুবিধা বা কর ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থাটি প্রত্যাহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। করসুবিধা বলতে কর অবকাশ এবং কর রেয়াতকে বোঝানো হয়েছে। ফাইভ স্টার হোটেল বা অন্যান্য বড় হোটেলের জন্য যেসব মালামাল আমদানি করা হয়, তার ওপর বড় ধরনের কর রেয়াত দেওয়া হতো। অন্যান্য আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে যেখানে ১০০ শতাংশ বা ১১০ শতাংশ ডিউটি চার্জ করা হয়, সেখানে হোটেলের মালিকগণ ১০ শতাংশ কর প্রদান করতেন। এখন এই সুযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু এসব পদক্ষেপ গ্রহণের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো কঠিন হবে। কারণ এতে খুব বেশি রেভিনিউ আসবে না। এনবিআর চেয়ারম্যান তো বলেছেন, কর অবকাশ এবং কর রেয়াতসুবিধা দেওয়ার কারণে বছরে আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো রেভিনিউ লস হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর রেয়াত এবং অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার করে যদি ৩০/৪০ কোটি টাকাও আদায় করা যায়, তাহলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হবে। 

রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনিক সংস্কার খুবই প্রয়োজন। চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে একটি নতুন মডেলের কথা শুনছি। বিশেষ করে, আয়করের ক্ষেত্রে প্রাইভেট এজেন্সির মাধ্যমে করদাতা চিহ্নিতকরণ এবং কর আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে। তবে এ ধরনের মডেল আমাদের মতো দেশে কার্যকর করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সর্বত্রই সুশাসনের অভাব রয়েছে। এজেন্ট হিসেবে কাদের নিয়োগ দেবেন। কাদের দক্ষতা আছে, তা নিশ্চিত হওয়া বেশ কঠিন কাজ। এজেন্টগণ করদাতাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন। কর প্রদানযোগ্য, কিন্তু কর দেন না—এমন ব্যক্তিরা খুবই ক্ষমতাবান। তাদের কাছ থেকে এজেন্টগণ কর আদায় করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, কর আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা এমন একটি মডেল কেন গ্রহণ করব, যেখানে আমাদের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আছে কর আদায়ের জন্য? 

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রতি বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তার একটি বড় অংশই অবাস্তবায়িত থেকে যায়। যতই দিন যাচ্ছে এক্ষেত্রে পরিস্থিতি শুধু খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো অর্থ ছাড় পাওয়া যায় না। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকে। আইএমইডি থেকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলা হয়েছে। সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে পরিস্থিতির কোনো দৃশ্যমান উন্নতি হচ্ছে না। প্রতি বছরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার কমে যাচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতার কারণে অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। যখন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে, তার আগেই জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে অন্য প্রাথমিক কাজগুলো সম্পন্ন করে আসতে হবে। যাতে ইসিএনইসিতে একটি প্রকল্প পাশ হওয়ার পরপরই তা বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে। অর্থবছরের শুরুতে ধীর গতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে আগে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বেড়ে যায়। এতে গৃহীত প্রকল্পের কাজের গুণমান খারাপ হয়। সেই সময় শুধু চেষ্টা করা হয় কীভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড় এবং ব্যয় করা যায়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের অর্থায়িত প্রকল্পগুলো তাদের বোর্ডে অনুমোদিত হওয়ার পরও ইসিএনইসিতে যেতে বছরখানেক সময় লেগে যায়। 

ব্যাংকিং কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংস্কারের জন্য নতুন একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এই খসড়া আইনটি মন্ত্রিপরিষদ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই খসড়া আইনে ব্যাংকিং খাতের জন্য কী কী সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা এখনই সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে কিছু কিছু বিষয় জানা গেছে। যেমন—ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে একই পরিবার থেকে চার জনের পরিবর্তে তিন জন পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু আগে একই পরিবার থেকে দুই জন পরিচালক নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারতেন। তারা দুই টার্ম অর্থাৎ ছয় বছর একটানা দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। বর্তমানে যে আইন বিদ্যমান আছে, তাতে একই পরিবার থেকে একযোগে চার জন পরিচালক নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারছেন। তারা তিন টার্ম অর্থাৎ ৯ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। চার জন পরিচালকের পরিবর্তে তিন জনের প্রস্তাব করা হলেও তাদের সময়সীমা বা মেয়াদকাল কিন্তু কমানো হয়নি। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা কী হবে বা সেই আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তার পরও বলতে হয়, একটি আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনে যদি কোনো অসংগতি থাকে, তাহলে তা পরবর্তী সময়ে সংশোধন করা যেতে পারে। আগামী সেপ্টেম্বর অথবা ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রস্তাবিত ব্যাংকিং সংস্কার আইন জাতীয় সংসদে পাশ হলে, তারপর এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে আইনটি কীভাবে কতটা নির্মোহভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তার ওপর। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কট করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করা হতে পারে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব হবে? ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিষয়টি এমন হতে পারে যে, বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ আছে। এটা ১০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা প্রয়োজন। 

মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে। এটা অর্জন করা বেশ কঠিন কাজ। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য যদি অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, শুধু তাহলেই অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশে সীমিত রাখা সম্ভব হতে পারে। আর অভ্যন্তরীণভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে হয়তো মূল্যস্ফীতির হার কমতে পারে। কিন্তু বাজেটে সে ধরনের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। সম্প্রসারণমূলক বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো ব্যবস্থা সাধারণত থাকে না। এ বছর সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাপক হারে ঋণ নিয়েছে। আগামী অর্থবছরেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজেটঘাটতি পূরণ করা হলে তা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ফলড ইকোনমিস্ট, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা অফিস
অনুলিখন : এম এ খালেক  

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন