সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

মানিক মিয়া : জাতিসত্তা গঠনের সম্পাদক

আপডেট : ০১ জুন ২০২৩, ০২:৫৯

কে লিখবে সেই ইতিহাস? বঙ্কিমচন্দ্র বেঁচে থাকলে হয়তো আক্ষেপ করতেন। কারণ আমাদের ইতিহাসের দৈন্য ও দুঃখ অনেক। বোধ হয় সবচেয়ে বড় দুঃখ এই যে, আমরা আমাদের কৃতী সন্তানদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারি না। মানিক মিয়া ছিলেন এ দেশেরই কৃতী সন্তান। তার কৃতিত্ব কেবল সাংবাদিকতার একজন মহান দিকপাল হিসেবেই নয়, তিনি ছিলেন এ দেশে জাতিসত্তার সংগঠক, গণতন্ত্রের ও আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ। তার ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ তীব্র কশাঘাতে একসময় জেগে উঠেছিল বাঙালি জাতি। তার লেখনী গোটা জাতি, বিশেষত এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলেছিল। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম সেই চেতনারই অবশ্যম্ভাবী ফসল। আমাদের স্বাধীনতা তাই ‘ইত্তেফাক’ ও তার অকুতোভয় সম্পাদক মানিক মিয়ার কাছে ঋণী। ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য রেখে এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিটি ঘটনাপরম্পরার পাতা ওলটালে এই ঐতিহাসিক সত্য আরো স্পষ্ট হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই সত্য আমরা ভুলে যেতে বসেছি। পণ্ডিত হর প্রসাদ শাস্ত্রী বাঙালিকে অভিহিত করেছিলেন ‘আত্মবিস্মৃত’ জাতি হিসেবে। এই আশঙ্কা আরেকবার মনে উঁকি মারে, যখন দেখি মানিক মিয়ার মতো একজন দেশপ্রেমিক খ্যাতিমান সাংবাদসেবীর জন্ম-মৃত্যু দিনে রাষ্ট্রীয় আয়োজন নীরব। আমাদের জাতীয় জীবন থেকে এই অনুদার ধারা কবে অপসৃত হবে?

সময়ের পথ পরিক্রমায় দৈনিক ইত্তেফাক এখন ৭০ বছরে পদার্পণ করেছে। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইত্তেফাক আত্মপ্রকাশ করেছিল একটি দৈনিক পত্রিকা হিসেবে। একটি জাতির ইতিহাসে সত্তর বছর তেমন কোনো বয়স নয়, কিন্তু সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি সংবাদপত্রের সত্তর বছরকাল ধরে অব্যাহত প্রকাশনা বড় বিস্ময়কর। এটা কেবল কোনো সংবাদপত্রের দীর্ঘায়ুই নয়, পরমায়ুও বটে। ‘ঢাকা প্রকাশ’ নামক যে সাপ্তাহিক পত্রিকাটি উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে বিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল এবং অনেক বার মালিকানা বদল সত্ত্বেও পত্রিকাটি শতবর্ষী হতে পেরেছিল, তা ছিল মূলত বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি বিরল গৌরব। কিন্তু সময়ের ধকলে ঢাকা প্রকাশ টিকে থাকতে পারেনি। টিকে থাকতে পারেনি দৈনিক আজাদ। একটি বিশেষ ধারার রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে আজাদ পত্রিকার জন্ম। কিন্তু কালক্রমে সেই রাজনীতির আবেদন যেমন ফুরিয়েছে, পত্রিকার জনপ্রিয়তাও তেমনি হ্রাস পেয়েছে দিনে দিনে। ইত্তেফাক এ ক্ষেত্রে বরাবরই ব্যতিক্রম। ইত্তেফাক পত্রিকাটির জন্ম হয়েছিল একটি প্রত্যয় দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে। মানিক মিয়া সম্পাদিত ইত্তেফাক ছিল একটি ‘মিশন’। গোড়া থেকেই একটি ‘কমিটমেন্ট’ ছিল ইত্তেফাকের। যে কারণে ইত্তেফাক পরিণত হয়েছিল পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ‘কথা বলার ফোরাম’ বা ‘পিপলস্ পার্লামেন্ট’-এ। যখন প্রচলিত পার্লামেন্টে বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলার কেউ ছিল না, তখন  ইত্তেফাকই পরিণত হয়েছিল ‘জনগণের মুখপত্রে’।

১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ খাজা নাজিমউদ্দিন গ্রুপ কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপ প্রাধান্য বিস্তার করে। কলকাতায় এই গ্রুপের মুখপত্র ছিল সাপ্তাহিক মিল্লাত। নাজিম উদ্দিন গ্রুপকে তখন সমর্থন জোগাত দৈনিক আজাদ। সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নাজিমউদ্দিন গ্রুপকে মোকাবিলা করতে আবুল মনসুর আহমদকে সম্পাদক করে বের করেন দৈনিক ইত্তেহাদ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর নানা কারণে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ রাজনৈতিক কোণঠাসা হলে নাজিমউদ্দিন গ্রুপ পূর্ব বাংলায় এসে ক্ষমতা দখল করে। কিছুদিন পর দৈনিক আজাদ পত্রিকাও ঢাকায় এসে মুসলিম লীগকে সমর্থন জোগাতে থাকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনেক বাধাবিপত্তির পরে অবশেষে পাকিস্তানে আসেন এবং বিরোধী দলের সংগঠনে মনোনিবেশ করেন। তারই প্রচেষ্টায় ও উত্সাহে বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। কিন্তু এ সময় বিরোধী দলের কোনো সমর্থক সংবাদপত্র ছিল না। কলকাতার ইত্তেহাদ পত্রিকাটি ঢাকায় সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু লীগ সরকার অনুমতি দেয়নি। ফলে বিরোধী দলের ‘মুখপত্র’ হিসেবে একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজন দেখা দেয়। তারই ফল ছিল ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’। কিন্তু অভাব ছিল যোগ্য সম্পাদক ও ব্যবস্থাপকের। মানিক মিয়া কলকাতায় দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশভাগের পরে কিছুকাল কলকাতা থেকে তিনিও তখন ঢাকায়। অতএব, পত্রিকাটি প্রথমে সম্পাদনার দায়িত্ব ও পরে পূর্ণ কর্তৃত্ব তার ওপরই বর্তায়। এখন হয়তো অনেকেই জানেন না যে, মানিক মিয়া কলকাতা থেকে ফিরে নিজেও সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার চিন্তা করেছিলেন। সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায়, তফাজ্জল হোসেন একসময় ‘ভয়েস’ ও ‘জবাব’ নামে দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি চেয়েছিলেন। তিনি সম্ভবত একটি ইংরেজি ও একটি বাংলা সাপ্তাহিক বের করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতি তার সেবার জন্য অপেক্ষা করছিল। ফলে তিনি ইত্তেফাকের পেছনেই তার সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর নূরুল আমিনের মুসলিম লীগ রাজত্বের কীর্তিকলাপ নিয়ে ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ শীর্ষক ‘মুসাফির’ ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন রাজনৈতিক নিবন্ধ। প্রথম লেখাতেই চারদিকে হইচই পড়ে যায়। কেননা, ‘মুসাফির’-এর ভাষা ছিল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, নাগরিক, ‘বুদ্ধিজীবী-কলমবাজদের’ ভাষা নয়। শহরে আগত গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি সেই ভাষার মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিল। এভাবেই শুরু হয়েছিল ইত্তেফাকের গণমুখী অভিযাত্রা।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকালে মানিক মিয়ার বলিষ্ঠ লেখনীতে ও সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের যে সংবাদচিত্র মেলে, তা সমসাময়িক ইতিহাসের একটি অনবদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল। মানিক মিয়ার কাছে ভাষা আন্দোলন পর্বটি ছিল একটি বৃহৎ সংগ্রামের পটভূমি বা প্রস্তুতিকাল। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে সম্পাদক মানিক মিয়া প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগকে মোকাবিলা করার। এজন্য একটি বৃহত্তর আয়োজনের প্রয়োজন ছিল। বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে সায় পাওয়া গেল। ফলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উত্সাহে ও অনুপ্রেরণায় মানিক মিয়া এককভাবে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর এভাবে আত্মপ্রকাশ করে দৈনিক ইত্তেফাক। তিনি হলেন এই পত্রিকার একাধারে প্রকাশক ও সম্পাদক। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হলো, মানিক মিয়ার পরিচালনাধীন দৈনিক ইত্তেফাক আত্মপ্রকাশ করার পরও দলীয় ‘মুখপত্র’ হিসেবে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ দৈনিক ইত্তেফাক ছিল একটি স্বতন্ত্র প্রয়াস। যদিও দীর্ঘকাল রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদ এই পত্রিকার ওপর ছিল। মানিক মিয়াও পরোক্ষভাবে বিরোধী দলকে প্রয়োজনমতো সমর্থন জোগাতেন। কাগমারী সম্মেলনের পরে আওয়ামী লীগ সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ প্রকাশ করলে দলের বোঝা ইত্তেফাকের ওপর থেকে আরো হালকা হয়। তা সত্ত্বেও সরকারি মহলে ও জনসাধারণের মধ্যে ইত্তেফাক সম্পূরক দলীয় পত্রিকা হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। মানিক মিয়া এ সময় ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ শিরোনামে ও ‘মুসাফির’ ছদ্মনামে যে কালজয়ী কলামটি লেখা শুরু করেন, তা অল্প দিনের মধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সে সময় যারা দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘মুসাফির’ লিখিত সম্পাদক মানিক মিয়ার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ পড়েছেন, তারাই কেবল উপলব্ধি করতে পারবেন সেই জনপ্রিয়তা ছিল কত বিপুল, সেই লেখনী ছিল কত শক্তিধর। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন প্রাক্কালে ইত্তেফাক কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, সরকারি দপ্তরের গোপন রিপোর্টেও তার প্রমাণ মেলে। এ সময় হোম (পলিটিক্যাল) ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে উল্লেখ কর হয় :

‘Ittefaq, published from and printed at the paramount press, 9, Hatkhola Road, Dacca by Tafazzal Hossain who is also its Editor. It has got a large circulation and wide popularity among the masses. It is an organ of the Awami League and it is a strong supporter of the united front party. It vehemently criticizes the Muslim League and league administration.’

ইত্তেফাকের জনপ্রিয়তা তখন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, খোদ সরকারি দপ্তরে মুসলিম লীগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইত্তেফাক সংগ্রহের ব্যাপারে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের আগ্রহ লক্ষ করা যায়। এমনকি, ১৯৫৪ সালের ১ মে পূর্ব বাংলা সরকারের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প দপ্তর থেকে সরকারের হোম ডিপার্টমেন্টে চিঠি লিখে প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারিরও অনুরোধ জানান। এই চিঠিতে বলা হয় :

‘The Daily Ittefaq of Dacca does not appear to have been included in the list of newspapers that may be subscribed for the use of the officers at Government Cost. Deputy Secretary Commerce, labor and Industries prefers this paper to the Azad. Home (C.S) department may please issue necessary orders for the inclusion of this paper in the list of approved newspapers.’

উপরোক্ত সরকারি নথি দেখে মনে হচ্ছে, মুসলিম লীগ সরকার এত দিন সরকারি দপ্তরে ইত্তেফাক নিষিদ্ধ করে রাখলেও শেষ পর্যন্ত জনপ্রিয় এই পত্রিকাকে সরকারি দপ্তর ও কর্মকর্তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়।

মানিক মিয়া কেবল ইত্তেফাক প্রকাশ করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। পূর্ব বাংলার বঞ্চনা ও স্বাধীকারের বিষয়টি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও শোষকদের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। এ ব্যাপারেও তাকে উত্সাহ জুগিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৪ সালে মানিক মিয়া New Nation নামে একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ১৯৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে সেই অনুমতি দিয়েছিল।

ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন, পরবর্তীকালে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পালটে যায়। একটি প্রতিকূল ও বিরুদ্ধ পরিবেশে তখন আর ডেইলি নিউ নেশন পত্রিকা প্রকাশ করা মানিক মিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অনেক পরে তিনি অবশ্য সাপ্তাহিক Dacca Times বের করেছিলেন। এখন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে যে ‘নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস’ কথাটি ছাপা হয়, সেটি মানিক মিয়ার সেই ডেইলি নিউ নেশন প্রচেষ্টার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন