শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কেএনএফের বৃহৎ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সেনাবাহিনীর দখলে

*বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার

*আইইডি বিস্ফোরণে সেনাবাহিনীর এক জন নিহত

আপডেট : ০২ জুন ২০২৩, ০১:০৮

বান্দরবানের রুমায় সেনাবাহিনীর একটি টহল দল কেএনএফের (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সদর দপ্তরসহ বৃহৎ গোপন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দখল করেছে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। এই অভিযানে আইইডি বিস্ফোরণে সেনাবাহিনীর এক জন সদস্য নিহত হয়েছেন। 

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এই তথ্য জানায়। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থান মূলত জেএসএস মূলে এর প্রধানের পৃষ্ঠপোষকতায়। সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার পাহাড়ি জনপদে ক্রমাগত হত্যা, অপহরণ, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টি করে চলেছে। অনেকে এলাকাছাড়া হয়েছে। এসব এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন পাহাড়ি-বাঙালি নেতারা। তারা সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।

কেএনএফের বৃহৎ এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প এলাকার আশপাশে বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে রুমা সেনা জোনের একটি টহল দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঐ ক্যাম্পের উদ্দেশে যাত্রা করে। কেএনএফ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছলে কেএনএফ সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলটি পালিয়ে যায়। তবে ঐ সময় কেএনএফের পুঁতে রাখা আইইডি (ইমপ্র্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণে সৈনিক তুজাম (৩০) আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হেলিকপ্টার দিয়ে তাকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহিদ সেনাসদস্যের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। 

আইএসপিআর জানায়, সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত দল কর্তৃক এ ধরনের আরও সম্ভাব্য আইইডি শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

অভিযান শুরুর আগে গত ২৮ মে দুপুরে বান্দরবান সেনানিবাসের অফিসার্স ম্যাসে বান্দরবান রিজিওনের নবাগত কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ জেলার স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘কোনো গোষ্ঠী যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়, তার জন্য আলোচনার দরজা খোলা থাকবে। কোনো গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়লে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কাউকে একবিন্দুও ছাড় দেওয়া হবে না।’

বান্দরবানের রুমা উপজেলার থিনদলতে লাং নামক স্থানে কেএনএফের ঘাঁটিতে সেনাবাহিনীর একটি চৌকশ দল অভিযান পরিচালনা করলে কেএনএফের সদস্যরা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়। উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, স্থাপনকৃত আইইডি ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদি। সেনাবাহিনীর আভিযানিক দলটি এখন এলাকাটিকে সর্বসাধারণের জন্য নিরাপদ করে তুলতে এর আশপাশে কেএনএফের পুঁতে রাখা আইইডির সন্ধান করে তা উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে।

২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ফেসবুক পেজে ঘোষণা দিয়ে উত্থান হয় নাথান বমের এই সন্ত্রাসী বাহিনীর। কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই বাহিনীর উত্থান বলে নাথান বম ঘোষণা দিলেও নাথানের পথ ও পন্থাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন পাহাড়ি-বাঙালিরা। এর পর থেকেই সাধারণ জনগণের ওপর শুরু হয় কেএনএফের সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকি, অপহরণ, অত্যাচার, খুন ও ব্যাপক চাঁদাবাজি। বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকার কিছু কুকি-চিনপাড়ার নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে কেএনএফের সন্ত্রাসীরা গড়ে তোলে তাদের শক্ত ঘাঁটি। কেএনএফের উত্থানের পর থেকেই সেনাবাহিনী অভিযানে নামে।

গত ৩ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের জঙ্গি ও কেএনএফ বিরোধী যৌথ অভিযান। ধরা পড়ে অধিকাংশ জঙ্গি ও কিছু কেএনএফ সদস্য। এতে কেএনএফ ক্ষুব্ধ হয়ে সেনাবাহিনীর ওপর চড়াও হয়। সেনাবাহিনীকে সহায়তার দায়ে নিরীহ মানুষের ওপরও চালায় অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। ফলে এ বছরের এপ্রিলের শুরুতে পুনরায় মাঠে নামে সেনাবাহিনী। এবারের অভিযানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে বিজিবি। যৌথ বাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ সহায়তা দিয়ে চলেছে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর একের পর এক আক্রমণে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা কিছুটা দুর্বল হলে কেএনএফের জিম্মা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে সাধারণ মানুষেরা। বর্তমানে তারা বিভিন্ন উপজেলা সদর এলাকার নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়েছে।

কেএনএফ উৎখাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা প্রদানের জন্য এলাকাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। এলাকাবাসীও এই সফল অভিযানের জন্য সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছে। একই সঙ্গে যারা অভিযানে শহিদ হয়েছেন, তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এলাকার পাহাড়ি-বাঙালিরা। তারা বলেন, পার্বত্য কোনো অঞ্চলেই যেন সন্ত্রাসীদের উত্থান হতে না পারে। আমরা অন্যান্য ৬৩ জেলার মতো নিরাপদে বসবাস করতে চাই। পার্বত্যাঞ্চল স্বাধীন সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশের একটি এলাকা।

ইত্তেফাক/এমএএম