বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। আমরা এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি সাধন করতে পারিনি। সবাই প্রত্যাশা করেছিলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর কিছু পদক্ষেপের কথা থাকবে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা উল্লেখ নেই। কীভাবে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা হবে, সে সম্পর্কে বাজেটে তেমন কিছু বলা হয়নি। অথচ এই মুহূর্তে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো আমাদের দেশেও মূল্যস্ফীতি সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ বড়ই অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে আমরা যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করছি, তার অনেকটাই বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। তার পরও অভ্যন্তরীণভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা এপ্রিলে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এটাই স্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি হারের তুলনায় বেশি। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে জুলাই মাসে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত বছরের মে মাসে তা ৩০ দশমিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। এর মধ্যে অবশ্য এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে (ইডিএফ) দেওয়া ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ, নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মোডিস সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের রেটিংয়ে অবমূল্যায়ন করেছে। এসব বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই প্রস্তাবিত বাজেটে। আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২০২৪) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। দেশের অর্থনীতির বিদ্যমান বাস্তবতায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য যেসব করণীয়, তার কোনো উল্লেখ বাজেটে নেই। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জ্বালানির সংকট শিল্প খাতের উৎপাদনকে ব্যাহত করছে। এছাড়া অবকাঠামোগত সংকট, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। এসব দিকে প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। অনেক দিন ধরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। এটা বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশের নির্দেশক নয়। যারা বিদেশি বিনিয়োগকারী, তারা কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট দেশের বাস্তব বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজমান রয়েছে। এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটাও বিনিয়োগকারীরা পর্যবেক্ষণ করছেন। বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের ফল। কোনো বিনিয়োগকারিই হুট করে কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। বিশ্বের যেসব দেশে ট্যাক্স-জিডিপির রেশিও সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তাদের একটি। নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি নেপালের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ২৩ শতাংশ। আর আমাদের ক্ষেত্রে এটা ৯ শতাংশের কম। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও কম হওয়ার কারণে আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ব্যাংক ঋণ অথবা বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়।
চলতি অর্থবছরের জন্য বিদেশে পাচারকৃত টাকা নির্ধারিত ৭ শতাংশ হারে ট্যাক্স প্রদানের দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এটা নিয়ে তখন নানা ধরনের সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কেউই দেশে টাকা ফেরত আনেননি। অর্থাৎ, এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, যারা টাকা বিদেশে পাচার করেন, তারা তা দেশে আনবেন না। আগামী অর্থবছরে এই সুযোগ আর দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। আমি সব সময়ই বলে এসেছি, এ ধরনের সুযোগ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। এ ধরনের সুযোগদান নীতিগতভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ এতে সত্ ও নীতিবান ব্যক্তিগণ যারা বৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করেন, তারা নিরুত্সাহিত হতে পারেন। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের সুযোগ থাকায় দেশে বিত্তবান ও বিত্তহীনের মাঝে আয়বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। এতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশে বিত্তবান ও বিত্তহীনের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্রুত বাড়ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন একটা বাড়ছে না। বর্তমানে দেশে যে আয়বৈষম্য বিরাজ করছে, তা কমানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাজেটেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
ব্যাংকিং সেক্টর খেলাপি ঋণভাড়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। ফলে উদ্যোক্তাগণ ব্যাংক থেকে অর্থায়ন সংগ্রহের ক্ষেত্রে তেমন একটা সহায়তা পাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে যারা ঋণখেলাপি তারা ক্রমাগত বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে যাচ্ছেন। একজন নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারী যদি কোনো আর্থিক ছাড় বা সুবিধা না পান, ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ (৯ শতাংশ) সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ কিছুটা তুলে নিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার যদি ৬ শতাংশ হয়, তাহলে তো আমনতকারীদের লোকসান হবে। কারণ মূল্যস্ফীতি সোয়া ৯ শতাংশের বেশি। আমানতের ওপর প্রদেয় সর্বোচ্চ সুদের হার প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে সাধারণ মানুষ ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণের ব্যাপারে উত্সাহী হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসনের অভাব রয়েছে। একধরনের বিশঙ্খলা বিরাজ করছে অধিকাংশ ব্যাংকে। এটা নিশ্চিতভাবে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের নিরুত্সাহিত করছে। বাইরে থেকে সবাই দেখতে পাচ্ছেন ব্যাংকের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। অনেকেই বলে থাকেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ অপরিবর্তিত রেখেছে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর পলিসি রেট বৃদ্ধির কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। এখানে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কিছুটা তফাত রয়েছে। আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়লেই যে মূল্যস্ফীতি কমবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির পেছনে বহির্বিশ্বের কারণগুলোই মূলত দায়ী। মূল্যস্ফীতির বৈশ্বিক কারণগুলো তো ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ জি টু পি পদ্ধতিতে সরাসরি উপকারভোগীদের কাছে পাঠানো হবে। এটা নিঃসন্দহে ভালো উদ্যোগ। সামাজিক নিরাপত্তার অর্থ যদি সরাসরি উপকারভোগীদের হাতে পৌঁছানো যায়, তাহলে সেটা নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে তালিকা মোতাবেক অর্থ পাঠানো হবে, সেই তালিকা কতটা সঠিক তার ওপর এর সাফল্য নির্ভর করবে।
বাজেটের উদ্দেশ্যই হলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা। কিন্তু আমাদের দেশে একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, বাজেটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, বছরান্তে তার বেশির ভাগই অবাস্তবায়িত থেকে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার আংশিক বাস্তবায়িত হয় মাত্র। বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকে। প্রথমত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তা বাস্তবস্মত নয়। ফলে সেই সব লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব রয়েছে। যে কারণে বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তার বেশির ভাগই অবাস্তবায়িত থেকে যায়। অথবা বাস্তবায়িত হলেও পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয় না। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা প্রতি বছর নির্ধারণ করা হয়, তা অর্জিত হয় না। আগামী অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতির বিদ্যমান বাস্তবতায় এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। একটি দেশের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ যদি প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়, তাহলে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে যারা আয়কর প্রদানযোগ্য, অর্থাৎ টিআইএনধারী (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর), তাদের অর্ধেকেরও কম ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করেন। প্রশাসনযন্ত্র এদের করের আওতায় আনার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। যারা টিআইএনধারী, তাদের তো বাধ্যতামূলকভাবে ট্যাক্স রিটার্ন দেওয়ার কথা। কেউ যদি টিআইএন নম্বর গ্রহণ করার পর নিয়মিত রিটার্ন দাখিল না করেন, তাহলে তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবে। টিআইএনধারীদের যাবতীয় তথ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু কেন তাদের চিহ্নিত করে করের আওতায় আনা হচ্ছে না, এটা আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ট্যাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের টেরিটোরিয়াল কাভারেজ বাড়াতে হবে। শহরে তো বটেই, এখন গ্রামাঞ্চলেও অনেক লোক আছেন, যারা কর প্রদানযোগ্য। তাদের চিহ্নিত করে কর নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা