মানুষ ভালো থাকিতে চাহে; কিন্তু এই ভালো থাকিবার সংজ্ঞা কী? আমরা মোটা দাগে বুঝিয়া থাকি, ভালো থাকা মানে নিরাপদে থাকা, কর্মের নিশ্চয়তা থাকা, নাগরিক হিসাবে নিজের প্রাপ্য অধিকার ভোগ করা এবং শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা। ভালো থাকা মানে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ন্যায্য অধিকার ভোগ করা এবং তাহার সেই দাবির প্রতি অন্যের যথাযথ সম্মান থাকা। ভালো থাকিতে হইলে সর্বদা যে প্রচুর অর্থ থাকিতে হইবে এমন নহে। সক্রেটিস বলিয়াছেন, ‘জাগতিক জীবনে ভালো থাকিতে প্রয়োজন কর্ম এবং জীবনকে উপভোগ করিবার মতো সময় ও পরিবেশ। আর তাহা পাইতে হইলে প্রয়োজন একটি গোটা কমিউনিটির মনের প্রশান্তি ও স্থিতিশীলতা।’ আধুনিক যুগে এই ভালো থাকিবার প্রশ্নে হয়তো নানা উপকরণ-উপজীব্য যোগ হইয়াছে; কিন্তু সক্রেটিসের উল্লেখ করা ভালো থাকিবার মৌলিক চাওয়া আধুনিক যুগেও অটুট রহিয়া গিয়াছে। কারণ আজও আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই চাওয়া হইতে বঞ্চিত হইতে দেখি।
ভালো কে না থাকিতে চাহে? কিন্তু এই ভালো থাকা উন্নয়নশীল দেশসমূহে হইয়া উঠে না। তাহার কারণ, এই সকল দেশে প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে দেওয়া হয় না। আধুনিক দেশের তকমা লাগাইয়াও এই সকল দেশ চলে উপজাতি সমাজের মতো। আর দেশ পরিচালনাকারীরা উপজাতি সর্দারের মতো দেশ চালান। কোনো যুক্তি মানা হয় না, জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনায় রাখা হয় না। এমন কি এই সকল দেশ যাহারা চালান তাহারা আইন-কানুনের তোয়াক্কা করেন না। তাহারা কেবলই ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থ দেখিয়া থাকেন। ইহার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারেন না। গোষ্ঠীর প্রতি প্রীতি যখন অন্ধত্বে রূপ নেয় তখন গোষ্ঠীর বাহিরে থাকা বিশালসংখ্যক মানুষ বঞ্চিত হইতে থাকে। যাহারা উপজাতি সর্দারের মতো পরিচালনা করেন, তাহারা এমন ব্যক্তিদের উপর আস্থা রাখেন যাহারা আস্থার যোগ্য তো নহেই, বরং বিপজ্জনক হইয়া উঠে।
এই সকল কারণেই, এই ধরনের দুর্বলতার কারণেই সমস্ত ভোগান্তি আসিয়া পড়ে সাধারণ জনগণের উপর। প্রচলিত আইন হয় উপেক্ষিত, মানুষ বঞ্চিত হয় তাহার অধিকার হইতে। বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। ইহাই যেন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রূপ লইয়াছে। ইহার কি কোনো ব্যত্যয় হইবে না? ব্যত্যয় হইবার সেই রকম কোনো উদাহরণ আমাদের সামনে নাই। ফলে জোরালো কণ্ঠে ইহা বলা যায়, যে পর্যন্ত এই গোষ্ঠীর স্বার্থ থাকিবে, যে পর্যন্ত সঠিক বিবেচনাকে উপেক্ষা করা হইবে, সে পর্যন্ত মানুষের ভোগান্তি কমিবে না। উন্নয়নশীল দেশের এই উপজাতি সর্দারের মতো দেশ পরিচালনা কোনো সভ্য সমাজ মানিয়া লইতে পারে না। তাই দেখা যায়, এই সকল দেশ পরিচালনাকারীদের প্রতি মানুষ আস্থা হারাইয়া ফালায়। জনগণও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। মনে রাখা দরকার, একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যদি কোনো অধিকার হইতে বঞ্চিত হয় তাহা হইলে ঐ বঞ্চনার রেশ তাহার চিন্তায় গাঁথিয়া যায়। তাহার ফল কখনোই ইতিবাচক হয় না।