শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পুরনো জীবনযাত্রায় কতোটা পরিবর্তন আনবে নতুন বাজেট?

আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ১৯:০৮

কঠিন এক সময়ে এলো প্রত্যাশিত বাজেট। যার প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনযাত্রায়। কমানো হয়েছে কৃষি খাতের বরাদ্দ। তবে, শিক্ষা ও আইসিটি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। অথচ শিক্ষা উপকরণ ও আইসিটি পণ্যের দাম বাড়ছে। বাজেটে প্রতিটি খাতই একটি অন্যটির সঙ্গে সংযুক্ত।

আমাদের দেশে বাজেট পাসের আগেই বাজারে প্রত্যক্ষভাবে এর প্রভাব পড়ে। তবে এটা ঠিক যে যাপিত-জীবনে কিছু পণ্য নিত্য আর কিছু পণ্য বিলাসদ্রব্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট আমাদের যাপিত জীবনে কতটুকু পরিবর্তন আনবে? মূলত কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে আর কোন পণ্যের দাম কমছে তার ওপর বিবেচনা করেই সমন্বয় করতে হয় জীবনযাত্রার। 

লাইফস্টাইলে বড়সড়ো পরিবর্তন আসতে পারে এই বাজেটে। এই যেমন: 

কাচ্চি বা বাসমতি চাল
সপ্তাহ শেষে বা কোনো উপলক্ষ পেলেই কাচ্চি বা বাসমতী চালের পোলাও খাওয়ার একটা ইচ্ছে জেগে ওঠে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে বাসমতি চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে এবার কাচ্চির দাম বাড়বে। যদিও বলা হচ্ছে, মাংসের দাম কমতে পারে। কিন্তু সেটা সমন্বয়ের মাধ্যমে কম রাখা হবে এমনটা প্রত্যাশা করা যাচ্ছে না। 

ভ্রমণ হবে ব্যয়বহুল
দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ এমনিতেই ব্যয়বহুল। তবে অনেকে একটু স্বস্তির খোঁজে দেশের বাইরেও ভ্রমণ করতে যান। বিশেষত ভারতে ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে অনেকের আগ্রহ থাকে বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে কেউ যদি সড়কপথে ভারত ভ্রমণ করে তাকে ১০০০ টাকা এবং বিমানে ভ্রমণ করলে ২০০০ টাকা কর দিতে হবে। শুধু তাই নয়, যারা দেশের অভ্যন্তরে বিমান সেবার মাধ্যমে যাতায়াত করেন তাদেরও কর দিতে হবে। অর্থাৎ ভ্রমণে ব্যয় বাড়ছে। 

সাজগোজের খরচে চাপ
প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশি কসমেটিকসের ওপর শুল্ক কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কসমেটিকস আমদানিতে শুল্ক কর আরও ১৭ শতাংশ বাড়িয়ে অর্থাৎ ২০ শতাংশ আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদেশি কসমেটিকস আমদানিতে আগে শুল্ক কর ছিল ৩ শতাংশ। এখন থেকে তা হবে ২০ শতাংশ। বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, অর্গানিক সার্ফেস অ্যাকটিভ উপকরণ, বার কেক ও বিভিন্ন সাবান তৈরির উপকরণ, ওয়াশিং ক্রিম, লিকুইড ক্রিম ও বিয়ের উপকরণের দাম বাড়বে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশি সাবান, লিকুইড সাবান ও ডিটারজেন্টের শুল্ক কর ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের বাজারে এমনিতেই বিদেশি কসমেটিকসের দাম বেশি। প্রস্তাবিত বাজেট পাস হলে রূপচর্চা চরম বিলাসিতা হয়ে উঠবে। 

কলমের কালি কম, দাম বেশি
কলমের দাম এতদিন বাড়েনি। অবশ্য কলমের কালি কমেছে। তারপরও মানুষ সন্তুষ্ট ছিল। যতো ঝামেলাই হোক, কলমের দামটা বাড়ে না। এবার সেই সন্তুষ্টিতে ভাটা পড়ছে। কারণ বাড়ছে কলমের দাম। কলম উৎপাদনে আগে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল। এখন সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। তাই কলমেও দাম বাড়বে। কলম এখনো আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। তাই আর কলম হারিয়ে ফেলা বা কলম অপচয়ের সুযোগ নেই। 

সানগ্লাস ও চশমা
চশমা অনেকের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়। যাদের চোখে দেখতে অসুবিধা হয় বা চোখের সমস্যা আছে তাদের জন্য চশমা জরুরি। এছাড়া অনেকে ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবে চশমা পরেন। এমনিতেই চশমার দাম বেশি। বিশেষত ভালো ফ্রেম কিনতে গেলে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়। আবার কড়া রোদ থেকে বাঁচতে অনেকে সানগ্লাস কেনেন। সেই সানগ্লাস ও চশমারও দাম বাড়ছে। বিশেষত বিদেশ থেকে আমদানি করা ফ্রেমে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে ২০ শতাংশ। আগে ছিল ৫ শতাংশ। তাই ভালো ফ্রেমের দাম এখন কত বাড়তে পারে তা সহজ অনুমেয়। 

ভেপ
সিগারেট ছাড়ার জন্য অনেকেই ই-সিগারেট বা ভেপ কেনেন। ভালো মানের ভেপের দাম এমনিতেই বেশি। তাছাড়া ভেপের নানা যন্ত্রপাতিরও দাম কম নয়। এবার প্রস্তাবিত বাজেটে সেই ভেপের দামও বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। 

তৈজসপত্রেও বিড়ম্বনা
রান্নাঘরে কিছু তৈজস কেনাই লাগে। আর নিয়মিত কয়েকটি প্লাস্টিক পণ্য কিনতে হবেই। সেই প্লাস্টিক ও তৈজসে আগে ভ্যাট ছিল ৫ শতাংশ। এবার তা প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্লাস্টিক সামগ্রী আর অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসের দাম বাড়ছে। সমস্যা এখানেই শেষ নয়। প্লাস্টিকের দাম বাড়া মানে বিভিন্ন খাতে প্যাকিংয়ে যে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, তারও দাম বাড়া। অর্থাৎ প্লাস্টিকের দাম বাড়লে লাইফস্টাইলের অনেক পণ্যেরও দাম বাড়বে। বিষয়টি সূক্ষ্মভাবে ধরা যাচ্ছে না। বিস্কুট  থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে এমন সব পণ্যই কিছু না কিছু দাম বাড়াতে পারে। 

গরমে টিস্যু ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনবেন?
টিস্যুর ওপর আগে ভ্যাট ছিল ৫ শতাংশ। এখন তা প্লাস্টিকের মতোই ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের টিস্যুর দাম বাড়ছে। আর এই বাড়তি দাম চুকানো একটু কঠিনই। প্রচণ্ড গরমে এবার টিস্যু ব্যবহারে সংযত হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে অনেককে। 

গাড়ির শখ যাদের
অনেকের একাধিক গাড়ি রয়েছে। কোথাও কোথাও এটি বিলাসিতা আবার কারো বা প্রয়োজন। যেমনই হোক, একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি থাকলে পরিবেশ কর দিতে হবে। 

ইলেকট্রনিক পণ্য
মাইক্রোওয়েভ ওভেন, কম্পিউটার, কম্পিউটার সরঞ্জামের মতো পণ্যের দামও বাড়ছে। এমনিতেই ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমায় এসব পণ্যের দাম বেশি। আর অধিকাংশ পণ্যই আমদানি-নির্ভর। এতদিন বাজারে এসব পণ্যের দামও বেশি ছিল। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি, ফ্রিল্যান্সিং খাত, লেখাপড়া, গবেষণা এমনকি অফিশিয়াল কাজের জন্যও কম্পিউটার পণ্য জরুরি। এছাড়া অনেকেই রান্নার কাজ সহজ করতে মাইক্রোওয়েভ ওভেন কিনে থাকেন। এই পণ্যেও দাম বাড়ছে। সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে অনেক কিছু। 

মোবাইল ফোন
বাজারে মোবাইল ফোনের দাম এমনিতেই বেশি। ভারত বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে  অনেক ফোন আছে যার দাম সাধ্যের ভেতর থাকলেও বাংলাদেশে একটু বেশিই। সেই মোবাইলের দাম আবার বাড়ছে।  

মোবাইল ডেটা
অনেকের বাড়িতে ওয়াই ফাই আছে তাই মোবাইল ডেটা অত লাগে না। কিন্তু সেটা তো যারা সারাদিন ঘরে থাকেন তাদের জন্য। সবাই তো আর ঘরের ভেতরে সারাদিন থাকেন না। বাইরে থাকলে বা কর্মজীবীদের ডেটা লাগেই। ডেটা প্যাকেজের দাম এমনিতেই বেশি। ভালো প্যাকেজের দাম বেশি মেয়াদ কম। এবার মোবাইল ডেটার দাম বাড়ার শঙ্কা পকেটের ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে। প্রয়োজনেই ডেটা কেনা লাগে। 

কিছু পণ্যের দাম কমলেও কতোটা প্রভাব ফেলবে লাইফস্টাইলে 
লাইফস্টাইলের অনেক পণ্যেরই দাম তো বেড়ে গেলো। তাই এখনই সমন্বয়ের কথা ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু লাইফস্টাইলে প্রভাব ফেলবে এমন কোনো পণ্যের কি দাম কমেনি? কমেছে। তবে তা আহামরি কিছু নয়। যেমন: 

মিষ্টি
বাজেটে মিষ্টি পণ্যের দাম কমানোর প্রস্তাবে মিষ্টি-প্রেমীরা একটু খুশি হতেই পারেন। কিন্তু মিষ্টির দাম কমানোতে জীবনযাপনে আহামরি পরিবর্তন আশা করা যাচ্ছে না। 

স্যানিটারি ন্যাপকিন
নারীর স্বাস্থ্য-সুরক্ষার জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন জরুরি। শুধু শহরের হিসেব করে লাভ নেই। আমাদের ভাবতে হবে জাতীয় পরিসরে। সে হিসেবে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম স্থিতিশীল থাকতে পারে অথবা কমতে পারে। 

ই-কমার্সের ডেলিভারি চার্জ
এখন অনেকেই ই-কমার্সে কেনাকাটা করেন। আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ই-কমার্সে কেনাকাটার ক্ষেত্রে ডেলিভারি চার্জটা বেশি মনে হতে পারে। এবার সে চার্জ কমছে। কারণ ই-কমার্সে পণ্য বিক্রয়ের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ছাড় দেওয়া হতে পারে।

ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা ও ক্যান্সারের ওষুধ
স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা ও ক্যান্সারের ওষুধ অনেক ব্যয়বহুল। এসব ওষুধের দাম কমছে। এটা একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।

অভিজাত বিদেশি পোশাক
অভিজাত পোশাকের প্রতি অনেকের আগ্রহ থাকে তুঙ্গে। এবার তাদের জন্য একটি সুখবর হতে পারে অভিজাত বিদেশি পোশাকের ওপর ২০-২৫ শতাংশ কর কমিয়ে ৫-১০ শতাংশ করা হতে পারে। তাই ফ্যাশনের ক্ষেত্রে একটু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। 

প্রস্তাবিত বাজেটে প্রত্যেকের লাইফস্টাইলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে চলেছে এটা বলাই যায়। একদমই প্রয়োজনীয় এবং পরিচিত পণ্যের দাম বাড়ছে। এর প্রভাব দ্রুত পড়তে শুরু করেছে বাজারে।

ইত্তেফাক/এআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন