রোববার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

এ মিছিল থামবে কবে?

আপডেট : ০৫ জুন ২০২৩, ০২:৩১

বর্তমানে আত্মহত্যা একটি অন্যতম সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ নিজেদের জীবনের তুচ্ছ ঘটনায় অসন্তুষ্ট হয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে। স্নাতক পাশ শিক্ষার্থীরাও দীর্ঘদিন চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করছে। অপর্যাপ্ত বেতন; কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমূল্যের ফলে অনেক মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি দিচ্ছেন। অকালে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার প্রবণতা দেখে মনে হয় আত্মহত্যাই যেন মানুষের জীবনের সব দুঃখ-কষ্টের একমাত্র সমাধান। আত্মহত্যার এই মিছিল কি বন্ধ হবে না?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন। আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদনে আত্মহত্যাপ্রবণ বয়সের ধারণাও উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, আত্মঘাতী হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ছিলেন ৪৯ শতাংশ, ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি ৩৫ শতাংশ এবং ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সি ১১ শতাংশ। সেই সময় সবচেয়ে কম আত্মহত্যা করেছিলেন ৪৬ থেকে ৮০ বছর বয়সিরা, যা  পাঁচ শতাংশ।

সামাজিক, আর্থিক, পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়া, হতাশায় ভোগা আত্মহত্যার প্রধান কারণ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যৌতুক, নির্যাতন, বখাটের নিপীড়নে নারীদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আর্থিক টানাপড়েন বা অপর্যাপ্ত বেতনে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে না পারার কারণে পারিবারিক কলহ মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই আট মাসে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯৪ শতাংশ স্কুলগামী শিক্ষার্থী। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দেশে ১০১ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। স্নাতক পাশ করার পর দীর্ঘদিন ধরে চাকরি না পেয়ে অনেক চাকরিপ্রত্যাশী মানুষ তাদের এত বছরের অর্জিত সার্টিফিকেটও প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলছেন।

বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব দেখা যায়। তারা অল্প পরিশ্রমে অধিক ফলাফল আশা করে। সারা বছর না পড়ে পরীক্ষার আগমুহূর্তে পড়ে ভালো ফলাফল করতে আগ্রহী থাকে। যখন কয়েকটি পরীক্ষায় এভাবে ভালো ফলাফল করে, তখন এ প্রবণতা বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে পড়ার চাপ বাড়লে যখন পরীক্ষার আগে পড়ে শেষ করতে পারেন না, তখন তারা মনোবল হারিয়ে হতাশায় ভুগতে থাকেন এবং এক সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অভিভাবকদের সমবয়সি অন্য শিশুদের ভালো ফলাফল দেখে নিজের সন্তান বেশি অনুপ্রেরণা দিতে চাওয়া এক সময় সেই সন্তানের মধ্যে হীনম্মন্যতার জন্ম দেয়। নিজেকে ভালো ফলাফল করতে ও বাবা-মায়ের উচ্চাশা পূরণে অক্ষম দেখে আত্মহত্যার মাধ্যমে এই তুলনা ও অসম প্রতিযোগিতা থেকে মুক্তি পেতে চায়।

শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনা করলে পরীক্ষার সময় বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে না। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি গান, নাচ, অভিনয়, বিতর্ক ও খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সহপাঠ্যক্রমিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এতে শরীর ও মন ভালো থাকবে। প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার অভ্যাসের ফলে দেশের ও আন্তর্জাতিক খবর সম্পর্কে জানতে পারবে এবং এটি তাকে চাকরির পরীক্ষায়ও সহায়তা করবে। সরকারি চাকরি লক্ষ্য থাকলেও তা যেন জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জীবন একটি সরকারি চাকরির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আশপাশের মানুষের কথা দ্বারা কষ্ট পেয়ে যাতে ভুল সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। মাদক ও খারাপ বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে হবে, যাতে তারা কোনো খারাপ কাজে প্ররোচিত করতে না পারে।

ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলছেন, ‘আত্মহত্যা জীবনে সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়।’ আত্মহত্যা কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির সমাধান হতে পারে না। আমরা প্রত্যেকে সমান ক্ষমতা ও যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করিনি। আমাদের পক্ষে যা করা সম্ভব এবং যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে সত্ভাবে জীবন যাপন করা প্রয়োজন। জীবনে উত্থান-পতন আসবেই। সুখ যেমন সবসময় থাকে না, তেমনি দুঃখও ক্ষণস্থায়ী। তাই আমাদের অল্পতেই ভেঙে না পড়ে ধৈর্য ধরতে হবে। মানুষ হতাশ হলে খুব ছোট কারণেও নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন নিজেকে একা মনে করে এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এজন্য আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত কাজ করতে হবে। তবেই আমরা আগামী প্রজন্মকে সুখী সমৃদ্ধ পৃথিবী উপহার দিতে পারব।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন