বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভারতে রেল দুর্ঘটনা : আমরা শোকাহত

আপডেট : ০৫ জুন ২০২৩, ০৪:৩০

চারিদিকে কেবল রক্তমাখা লাশ আর লাশ। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়াইয়া-ছিটাইয়া রহিয়াছে—এইখানে একটি হাত পড়িয়া আছে, তো ঐখানে একটি পা। অনেকের চেহারা বিকৃত হইয়া গিয়াছে। প্রিয়জনের লাশ খুঁজিয়া না পাইয়া তাহার মোবাইল ফোনে কল দেওয়ার পর লাইনচ্যুত ট্রেনের বগির নিচ হইতে ফোনের রিংটনের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছে। স্বজনহারা ব্যক্তিবর্গের আর্তচিত্কারে ভারী হইয়া উঠিতেছে পরিবেশ। এমন দুঃসহ দৃশ্য কল্পনারও বাহিরে। অথচ এমন ঘটনার সাক্ষী হইলেন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতের নাগরিকগণ। গত শুক্রবার (২ জুন) কলকাতা হইতে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেন ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হইলে এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়, বিশেষত ভারতের ওড়িশাবাসী। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাইয়াছেন ২৯৫ জনেরও অধিক যাত্রী। আহতের সংখ্যা সহস্রাধিক। দুর্ঘটনায় হতাহতদের মধ্যে রহিয়াছেন অন্য দেশের নাগরিকগণও। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনে থাকা কয়েক জন বাংলাদেশি নাগরিক আহত হইলেও কাহারও নিহত হইবার খবর পাওয়া যায় নাই। এই মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনায় আমরা শোকাভিভূত। ইহার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ভুক্তভুগীদের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়াছে, ভারতে সাম্প্রতিক কালে ট্রেন দুর্ঘটনা অধিক হারে বাড়িয়া গিয়াছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত লাইনচ্যুত হইয়াছে ১ হাজার ১২৭টি ট্রেন, যাহাতে বহু প্রাণহানির পাশাপাশি হইয়াছে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি। রেললাইনগুলির সক্ষমতা মূল্যায়নে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে রেলপথে এমন দুর্ঘটনা ক্রমশ বাড়িতে পারে। অধিকাংশ দুর্ঘটনার পিছনে রেললাইনের রক্ষণাবেক্ষণ ঘাটতিও কম দায়ী নহে। দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনচালকদেরও বড় ধরনের দায় রহিয়াছে। বাজেভাবে ট্রেন চালানো, অতিরিক্ত গতিসহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রেললাইন নবায়ন না করাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সবচাইতে বড় বিষয় হইল, ভারতে জালের মতো ছড়াইয়া রহিয়াছে রেললাইন বিধায় রেল দুর্ঘটনা এই দেশে নূতন নহে। আরো পরিষ্কার করিয়া বলিতে হয়, সিগন্যাল ত্রুটির কারণে আজকাল পশ্চিমা দেশেও এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিতে দেখা যায়। যদিও আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থায় এই ধরনের দুর্ঘটনা তেমন একটা ঘটিবার কথা নহে। একমাত্র আমেরিকায় রেল দুর্ঘটনা তেমন একটা ঘটিতে দেখা যায় না। অবশ্য দেশটিতে রেলওয়ের ব্যবহার ১ শতাংশও নহে। ভারতের ইতিহাসে সবচাইতে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা অন্যান্য দেশের জন্যও শিক্ষণীয়।

বিশেষ করিয়া, উন্নয়নশীল দেশগুলির রাষ্ট্রীয় খাতে রেলওয়ে ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এই সকল দেশের জরাজীর্ণ রেলপথ সংস্কারের বিকল্প নাই। এই খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহারও আবশ্যক। ত্রুটিপূর্ণ রেললাইন তথা ফাটলযুক্ত রেললাইনের সংকোচন-প্রশমনের দিকেও নজর দিতে হইবে। সময়ের সহিত তাল মিলাইয়া রেলপথের গুরুত্ব বাড়িলেও বিভিন্ন দেশে এই খাতে লাগে নাই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও উন্নতমানের সেবার ছোঁয়া। রেলপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করিয়া অনেকে বুলেট ট্রেনের কথাও ভাবিতেছেন। প্রশ্ন হইল, আধুনিক বিশ্বে আকাশপথে চলাচলকে আমরা অনেকটাই নির্বিঘ্ন করিতে সক্ষম হইয়াছি, বিমান দুর্ঘটনার কথা আমরা কালেভদ্রে শুনিতে পাই। অনুরূপভাবে রেলযাত্রাকে কেন নিরাপদ ও নিষ্কণ্টক করা যাইবে না? উন্নত দেশে রেলওয়ে খাত ক্রমাগতভাবে উন্নত হইতেছে, আধুনিক প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসিয়া ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করিতেছে। ইহার সুফলও ভোগ করিতেছে সেই সকল দেশের মানুষ। তাহা হইলে উন্নয়নশীল বিশ্বে রেলপথ বেহালে পর্যবসিত হইবে কেন? বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করিয়া দেখিবার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

ভারতের ওড়িশায় তিনটি ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা লোমহর্ষক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বনেতৃবৃন্দ ইহাতে শোক প্রকাশ করিয়াছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করিয়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়াছেন। আমরা আশা করি, ভারতের নাগরিকগণ এই শোকসন্তাপ শীঘ্রই কাটাইয়া উঠিবেন। এই বিপদে সৃষ্টিকর্তা তাহাদের ধৈর্য ধারণ করিবার সাহস ও শক্তি দিন।

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন