মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নরকের আগুন কি মর্ত্যে নামিয়া আসিয়াছে?

আপডেট : ০৭ জুন ২০২৩, ০২:৫০

সেই শত বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার সংগীতের মাধ্যমে বলিয়া গিয়াছেন—‘নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।/ খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা।’ আরেক জায়গায় লিখিয়াছেন—‘প্রখর তপনতাপে/ আকাশ তৃষায় কাঁপে,/ বায়ু করে হাহাকার।’ কয়েক বৎসর ধরিয়া মে-জুন মাসে আমরা যেন আমাদের প্রকৃতি জুড়িয়া দারুণ দহনবেলার নীরব ভৈরব খেলা দেখিতেছি। একদিকে তাপমাত্রা ৪০ হইতে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অন্যদিকে বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা যথেষ্ট মাত্রায় কম। সকল কিছু মিলাইয়া সমগ্র বাংলা যেন প্রখর সূর্যতাপে ঝাঁঝাঁ করিতেছে। প্রকৃতি যেন খেপিয়া গিয়াছে! সমগ্র দেশে প্রচণ্ড গরমের সহিত পাল্লা দিয়া বাড়িতেছে লোডশেডিং। চরম ভোগান্তিতে পড়িয়াছে মানুষ। লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ রাতে ঘুমাইতে পারিতেছে না। কালকারখানায় উৎপাদন বন্ধ রহিয়াছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা বন্ধ হইবার উপক্রম। দিনে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ চলিয়া যাইতেছে বিধায় কারখানায় মেশিনের চাকাই ঘুরিতেছে না। ইহার সহিত প্রচণ্ড গরমের কারণে মানুষ দিনের বেলায় কাজে যাইতে পারিতেছে না। ফলে নির্মাণশিল্প ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হইতেছে। কৃষি খাতেও ইহার প্রভাব পড়িতেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় স্কুলে গিয়া গরমে শিশুরা প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে পড়িতেছে। বিষয়টি বিবেচনা করিয়া সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করিয়াছে। 

জানা গিয়াছে, বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং চলিতেছে। জ্বালানিসংকটের কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যাহত হইতেছে। এই কেন্দ্রের জ্বালানি কয়লা আমদানি করিতে আরো অন্তত ২০-২৫ দিন সময় লাগিবে বলিয়া জানা গিয়াছে। অর্থাৎ সকল কিছু মিলিয়া পরিস্থিতি গোদের উপর বিষফোড়ার মতো। এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটার্স জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হইয়াছে প্রচণ্ড গরমের এমন প্রতিকূল আবহাওয়া বা হিউমিড হিটের কারণে যেই সকল দেশ শ্রম ও উৎপাদনশীলতা হারাইতেছে—এমন শীর্ষ পাঁচ দেশের কাতারে উঠিয়া আসিয়াছে বাংলাদেশ। মারাত্মক ব্যাপার হইল, আবহাওয়ার এমন বিরূপ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ প্রতি বৎসর ৩ হাজার ২০০ কোটি কর্মঘণ্টা হারাইতেছে।

প্রকৃতির এই ভয়াবহ অবস্থা কেবল বাংলাদেশের নহে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা গিয়াছে, খরা, বন্যা ও দাবদাহের প্রভাব পড়িতেছে সকল মহাদেশের মানুষের উপর। এই দুর্যোগে ক্ষতি হইতেছে কোটি কোটি ডলার। ডব্লিউএমও তাহাদের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে জানাইয়াছে—দাবদাহের কারণে গত বৎসর ইউরোপ জুড়িয়া মৃত্যু হইয়াছিল কমপক্ষে ১৫ হাজার ৭০০ মানুষের। ইতিপূর্বে গত বৎসর বৈশ্বিক তাপমাত্রার অবস্থা ফুটাইয়া তুলিতে পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধের ১৩ জুলাইয়ের বায়ুর তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে নাসা একটি মানচিত্র প্রকাশ করিয়াছিল। মানচিত্রে দেখা যায়, উত্তর আফ্রিকা জুড়িয়াই প্রচণ্ড দাবদাহ চলিতেছে। সেই সময় স্পেনসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশ পর্তুগাল ও ফ্রান্সে দাবদাহে সৃষ্ট দাবানল ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। পরিস্থিতি দেখিয়া ইউরোপের আবহাওয়াবিদ বলিয়াছেন—‘ইহা যেন নরকের আগুন!’ ফ্রান্সের দাবানলে পুড়িয়া যায় ৩৭ হাজার একরেরও বেশি এলাকা। পর্তুগালে ৭ হাজার ৪০০ একর জমি দাবানলে পুড়িয়া যায়। ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড দেখিয়াছে যুক্তরাজ্য। দেশটির ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ইরানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করে। এই সকল পরিসংখ্যান গতবারের। এইবার নাকি অবস্থা আরো খারাপ হইবে। তাহার আলামত আমরা আগেভাগে পাইতে শুরু করিয়াছি। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করিয়াছেন বিশ্বের উষ্ণায়নকেই। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই সাহারা আরো অধিক উষ্ণ হইতেছে এবং সাহারার লু হাওয়া ছড়ি ঘুরাইতেছে ইউরোপ জুড়িয়া। কয়েক দিন পূর্বে কুয়েতে সর্বকালের রেকর্ড ভাঙিয়া ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছুঁইয়া যায়। মনে রাখিতে হইবে, এই পৃথিবীতে দুর্যোগ কাহারো একার জন্য আসিবে না। একটিই ছাদ এই ধরিত্রীর। সুতরাং এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইতে যাহা করণীয়, তাহা করিতে হইবে। নচেৎ নরকের আগুন ফি বৎসর আরো বেশি করিয়া উত্তাপ ছড়াইবে বিশ্ব জুড়িয়া। আর প্রতি বৎসরই যেহেতু এই অবস্থা ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে, সুতরাং সরকারের উচিত হইবে এই ধরনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সঠিক পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন